ডুমুরিয়া বাঁধে দ্বিতীয় দফায় ভাঙন, দুর্নীতির অভিযোগ
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর বেড়িবাঁধ দুই দফা ভাঙনের ফলে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আজ সোমবার দ্বিতীয় দফা ভাঙনে ভেসে গেছে হাজার হাজার চিংড়িঘের। অবর্ণনীয় কষ্টে আছে জলাবদ্ধ এলাকার এসব মানুষ। আর এ অবস্থার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দায়ী করছেন।
প্রথম দফায় গত ১ আগস্ট খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় ভদ্রা নদীর চাঁদগড় এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। শত শত লোক স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেও সে বাঁধনিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পরে প্রায় দীর্ঘ এক টানা স্বেচ্ছাশ্রম, উপজেলা পরিষদ ফান্ড, আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নের প্রায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ের পর চলতি মাসের ১৮-১৯ তারিখে সে বাঁধ নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু সাতদিনের মাথায় বাঁধটি গতকাল ২৭ সেপ্টেম্বর রোববার দুপুরে নদীতে জোয়ারের পানির প্রচণ্ড চাপে আবারও ভেঙে যায়।
এর ফলে ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়ন ও বটিয়াঘাটা উপজেলার আমীরপুর ইউনিয়নের বড় অংশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার পুকুর ও চিংড়িঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। আমন ফসলের ক্ষেত জোয়ারের লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান আলী মনসুর দাবি করেছেন, এলাকায় মানবিক বিপর্যয়সহ কয়েকশ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডুমুরিয়ার এই বেড়িবাঁধ সংস্কারকাজ যদি নির্দিষ্ট সময় সম্পন্ন করা হতো তবে বাঁধ ভাঙত না। এই ভাঙনের ফলে ৪২ লাখ টাকার ঠিকাদারি কাজ গিয়ে দাঁড়াবে ২০ কোটি টাকার ওপরে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর ধরে বাঁধ মেরামতের জন্য প্রথমবার ২৩ লাখ, পরে নয় লাখ আর এবার ৪৩ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার এক কিলোমিটার বাঁধ সংস্কারের জন্য গত মার্চ মাসে দরপত্র আহ্বান করেছিল। কিন্তু ৩৫ জন ঠিকাদার শিডিউল কিনলেও ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করার জন্য প্রাক্কলন ব্যয়ের চেয়ে ৯ শতাংশ ঊর্ধ্বদর দিয়ে মাত্র চারটি শিডিউল জমা পড়ে। ১২ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার এম ডি আবদুল খালেককে কাজের নির্দেশপত্র দিয়ে ২৫ জুন কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়। কিন্তু বাস্তবে আগস্ট মাসেও ঠিকমতো কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদার। ফলে নদীভাঙনে শরাফপুর ইউনিয়ন এবং বটিয়াঘাটার একটি ইউনিয়নের বড় অংশ জোয়ারে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কাঁচাঘরে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু সড়কের ওপর আর মাটির ঘর পানিতে মিশে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদারের অভিযোগ, দরপত্র সিন্ডিকেটের ফলে ৪৩ লাখ টাকার দরপত্রে সাত লাখ টাকাই কাজ শুরু আগে দরপত্র সিন্ডিকেটকে দিতে হয়। একাধিক ঠিকাদার অভিযোগ করেছেন এই সিন্ডিকেটের প্রধান সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। এ ব্যাপারে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সাত লাখ টাকা অন্য ঠিকাদারদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেওয়া হয়। সাংবাদিকদের জন্যও একটি বরাদ্দ থাকে, সাংবাদিকরা সিন্ডিকেট মানি ভাগ পায়। ৪৩ লাখ টাকার কাজ শুরুর আগে সাত লাখ দরপত্র সিন্ডিকেট এবং পাঁচ শতাংশ কার্যালয়ের খরচ দিলে তারপর কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার দরপত্রের অন্যতম শর্ত থাকে ঠিকাদারি কাজ কোনো সাব ঠিকাদারকে দেওয়া যাবে না। অথচ ডুমুরিয়ার চাঁদগড়ের এই কাজ ঠিকাদার আবদুল খালেক বিক্রি করে দেন খুলনার হাবিব বিশ্বাসের কাছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবর রহমান বলেন, দরপত্র সিন্ডিকেট হয়েছে এমন কোনো লিখিত অভিযোগ নাই। আর সাব ঠিকাদারি নয়, ঠিকাদার আবদুল খালেকের প্রতিনিধি হিসেবে হাবিব বিশ্বাস এখানে কাজ দেখা শোনা করতেন। তিনি স্বীকার করেন, নির্দিষ্ট সময়ের আগে মেরামতকাজ শেষ করা গেলে এই ভাঙন হতো না।
তবে হাবিব বিশ্বাস নিজেকে মূল ঠিকাদারের প্রতিনিধি দাবি করে জানান, এলাকাবাসী অসহযোগিতা করায় নিদিষ্ট সময় কাজ শুরু বা শেষ করা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি গফুর মোল্লা বলেন, নয় লাখ ৬৬ হাজার টাকার সংস্কারকাজে এক লাখ টাকা পায় জমির মালিকরা, আর এক লাখ দেওয়া হয় শ্রমিকদের, তাতেই শেষ নয় লাখ ৬৬ হাজার টাকার কাজ। ঠিকাদারদের কারসাজিতে যে ভাঙন হলো তা ২০ বছরেও ক্ষতিপূরণ হবে না।
ডুমুরিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান খান আলী মুনসুর বলেন, ‘ভাঙনের যে হাল হয়েছে, তাতে ২০-২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্ভব হবে না।’ তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির জন্য কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘এলাকার মানুষদের ক্ষতির মুখে ফেলে বোর্ডের কর্মকর্তাদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াটা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।’
পাঁচ বিঘা জমির মালিক ছিলেন চাঁদগড়ের জাকির হোসেন। এবারের ভদ্রা নদীর ভাঙনে তাঁর সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে অবস্থান নিয়েছে সড়কের ওপর। তারও ক্ষোভ ঠিকাদার আর পাউবোর বিরুদ্ধে। জাকির বলেন, ‘আমাদের দুর্গতিকে পুঁজি করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তারা আর ঠিকাদাররা নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘চাঁদগড়ের এই বাঁধের ভাঙন মানুষের সৃষ্টি।’