রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন মুজাহিদের
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছেন। আজ বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় তাঁর আইনজীবীরা এ আবেদন করেন।
urgentPhoto
মুজাহিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ৩৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনের নথি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন পরে বিস্তারিত জানাবেন বলেও জানান তিনি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে রায় প্রকাশ করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
পূর্ণ রায় প্রকাশের পর মুজাহিদ ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার সুযোগ পান। এ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার হন জামায়াত নেতা মুজাহিদ। এ ঘটনায় ২০১১ সালের ২১ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন কর্মকর্তারা। এর পর ২ আগস্ট তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ২০১২ সালের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। তার মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ বিভিন্ন দণ্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। দুটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। ওই বছরই ১১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন মুজাহিদ।
২০১৫ সালের ১৬ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত পাঁচ অভিযোগ
অভিযোগ-১ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার চামেলীবাগ থেকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণাধীন সাত-আট যুবক তাঁকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ-৩ : তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। ফরিদপুর পুরোনো সার্কিট হাউসে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরের রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তাঁর আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।
অভিযোগ-৫ : পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের আরেক নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে তাঁরা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাঁদের গালাগাল করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাঁদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটক একজনকে ছাড়া অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
অভিযোগ-৬ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প করে। পরে রাজাকার, আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প করে। মুজাহিদ ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন।
এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধনসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়নের মতো যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৭ : প্রসিকিউশনের আনা সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা চালায়।
এ ছাড়া ২ নম্বর অভিযোগ, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় সাড়ে ৩০০টি বাড়ি পুরোনো ভাঙচুর ও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০-৬০ হিন্দু নর-নারীকে হত্যা এবং ৪ নম্বর অভিযোগ, মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে আটকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।