মহারাজের পতন, ‘নৌকা’য় ছিল না আ.লীগ
বরগুনা পৌরসভায় নির্বাচনের দিন ৩০ ডিসেম্বর বেলা ১১টার মধ্যেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরূপ আচরণের অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কামরুল আহসান মহারাজ। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরপরই পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মাঝখানে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহারাজসহ ১১ নেতাকর্মী। তাঁদের মধ্যে গুলি লেগে নাজমুল নামের এক কর্মীর বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায় স্থায়ীভাবে।
গুরুতর আহত অবস্থায় কামরুল আহসান মহারাজকে প্রথমে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজ শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মহারাজকে দেখতে যান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের অপর যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক এবং দীপু মণিসহ অন্য নেতারা।
কামরুল আহসান মহারাজ একাধারে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের নীরব ভূমিকা, দলীয় বিশৃঙ্খলা এবং বিশ্বাসহীনতার অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। জেলা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতারাই পরোক্ষভাবে ‘নৌকা’র বিপক্ষে কাজ করেছেন এমন অভিযোগ তাঁদের।
বরগুনা পৌরসভার চরকলোনি এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক সমর্থক বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের মূল নেতারাই তো নৌকায় চড়ে নাই। তাইলে নৌকা চলব ক্যামনে? ’
জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ‘সারা জীবন বিশ্বস্ততার সঙ্গে সকল তর্কবিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন মহারাজ। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক ঊর্ধ্বতন পদে থাকলেও কোনোদিন তিনি কোনো অনিয়ম এবং দুর্নীতির আশ্রয় নেননি। আইন পেশায় নিযুক্ত থেকে সেখানকার আয় রোজগার দিয়েই তিনি তাঁর সংসার-জীবন নির্বাহ করতেন। এসব বিভিন্ন কারণে জেলা আওয়ামী লীগে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন মহারাজ। আর এই শক্ত অবস্থানই তাঁর জন্য কাল হয়েছে।’
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরগুনা জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘বরগুনায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে জেলা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডই দায়ী।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ নির্বাচনকে ঘিরে এখানে বড় অঙ্কের টাকা-পয়সারও লেনদেন হয়েছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্বাস হাসেন মন্টু মোল্লা বলেন, ‘দলীয় বিশৃঙ্খলার কারণেই এখানে নৌকা প্রতীকের পরাজয় হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরুল আহসান মহারাজের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মুজিবুল হক কিসলু বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. শাহাদাত হোসেনের কালো টাকার প্রভাবে এখানকার পুলিশ প্রশাসন শুরু থেকেই তাঁদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করতে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিন বরগুনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের অস্ত্রের মুখে হুমকি দিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় পুলিশ। এ ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রের এজেন্টদের সঙ্গেও একই আচরণ করে পুলিশ। দুপুরের দিকে মেয়র পদপ্রার্থী মহারাজসহ বেশ কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মী বরগুনা সরকারি কলেজ কেন্দ্রে উপস্থিত হলে পুলিশ তাঁদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় মহারাজের মাথায় গুলি লাগলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।’ একই সময় আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের আরো অনেক নেতাকর্মী সেখানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান তিনি। তিনি আরো জানান, এ অবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তাঁরা।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা না পেয়ে একপর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন কামরুল আহসান মহারাজ।’ তবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটা তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল বলেও জানান গোলাম সরোয়ার টুকু।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিশেষ করে কামরুল আহসান মহারাজের মতো একজন প্রার্থী যিনি একাধারে বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক, তাঁকে চাপের মুখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে এমনটা আমরা ভাবতেও পারিনি।’
বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হাসান তারেক পলাশ বলেন, ‘নির্বাচনে আমাদের পরাজিত করা হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা দলের নেতাকর্মীদের মাঝে অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতার সম্পর্কও সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব সুদূর প্রসারী।’
এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরগুনা ১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহারাজ এখনো গুরুতর অসুস্থ। তিনি সুস্থ হলে শিগগিরই জেলা আওয়ামী লীগের একটি মিটিং ডাকা হবে। এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ কী তা ওই মিটিংয়ের মধ্য দিয়েই জানা যাবে।’

সোহেল হাফিজ, বরগুনা