ভালোবেসে ঘর বেঁধে লাশকাটা ঘরে

প্রেম ছিল তাঁর, আশাও ছিল তাঁর জ্যোৎস্নায়। পাঁচ বছর আগের একদিন বেঁধেছিলেন ভালোবাসার ঘর। পাঁচ বছর পরের একদিন সেই ঘরে ‘গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’। বধূ শুয়ে ছিল বিছানার পাশে। হাসপাতাল ঘুরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁরে লাশকাটা ঘরে।
পরে চিকিৎসকরা জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াহিদা সিফাতের (২৭) মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আঘাতের দাগ।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ২০ লাখ টাকা যৌতুক না পেয়ে স্বামী মো. আসিফ ২৯ মার্চ সিফাতকে নির্যাতনে হত্যা করেন।
এ অভিযোগে আজ বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর রাজপাড়া থানায় মামলা করেছেন সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পাঁচ বছর আগে সিফাত ভালোবেসে রাজশাহী নগরীর আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন রমজানের ছেলে মো. আসিফকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরও আসিফ বেকার ছিলেন। সেই সময় ব্যবসা করতে আসিফ সিফাতকে বাবার বাড়ি থেকে ২০ লাখ টাকা এনে দিতে বলেন। এতে রাজি না হওয়ায় দিনের পর দিন তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলতে থাকে। বিয়ের আড়াই বছর পর তাঁদের ঘরে একটি ছেলেসন্তান জন্ম নেওয়ার পরও এই নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বিয়ের পর থেকে সিফাত স্বামীসহ শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একই বাড়িতে বাস করতেন। তাঁরা নির্যাতনের বিষয়টি জানলেও ছেলেকে কোনোদিন বাধা দেননি।
মামলায় আরো বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা সিফাত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুরে চাকরির জন্য আবেদন করেন। এই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে তিনি গত ২৯ মার্চ ঢাকার পল্লবীতে বাবার বাসায় যেতে রাত ১১টা ২০ মিনিটে ধূমকেতু ট্রেনের টিকিট কাটেন। ওই দিন রাত সোয়া ১০টার দিকে সিফাতের শ্বশুর রমজান মোবাইল ফোনে সিফাতের ভাই আসিফুল ইসলামকে জানান, সিফাত মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁর ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। এর পাঁচ মিনিট পর রমজান আবারও মোবাইল ফোনে জানান, সিফাত গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এবং তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সে মারা গেছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩)-এর ১১(ক)/৩০ ধারায় যৌতুকের দাবিতে হত্যা ও সহায়তা করার অপরাধে দায়ের করা এই মামলায় সিফাতের স্বামী মো. আসিফসহ তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন সিফাতের শ্বশুর মোহাম্মদ হোসেন রমজান ও শাশুড়ি নাজমুন নাহার নাজলী।
মামলার বাদী সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার অভিযোগ করেন, সিফাতের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি মোহাম্মদ হোসেন রমজানকে রাত ১২টার দিকে ফোন দেন। ফোনে রমজান জানান, সিফাতকে তাঁর স্বামী মাঝেমধ্যে মারপিট করত। তিনি তা মীমাংসা করে দিতেন।
মামলায় আরো অভিযোগ করা হয়, ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পরিবারের লোকজন ঢাকা থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে আসেন। এ সময় তাঁরা দেখেন সিফাতের মাথা ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন এবং নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। এ ছাড়া মাথার ডান দিকে চোখের পাশে রক্ত জমাট বাঁধা আছে।
মামলায় দাবি করা হয়, যৌতুকের জন্যই সিফাতকে হত্যা করা হয়েছে। এখন হত্যার ঘটনাকে আড়াল করতে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিফাতের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতের থুঁতনির নিচে এক ইঞ্চি পরিমাণ লালচে জখম ছিল। এ ছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের দেওয়া লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও সিফাতের মাথায় জখমের প্রমাণ মিলেছে।
সিফাতের গ্রামের বাড়ি রংপুর শহরে। তাঁর বাবা আমিনুল ইসলাম খন্দকার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক।
রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, ওয়াহিদা সিফাতের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসআই শরিফুল ইসলামকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিফাতের মৃত্যুর পরদিন তাঁর স্বামী মো. আসিফকে আটক করা হয়েছে। তাঁকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। এ ছাড়া অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।