লংগদুতে দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর
সারা দেশের তুলনায় গত ৪ জুন অনুষ্ঠিত রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলেই দাবি সবপক্ষের। কিন্তু নির্বাচন শেষ হতেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে।
লংগদু উপজেলার কালাপাকুজ্যা, গুলশাখালী, ভাসান্যাদম ইউনিয়নে পরাজিত চেয়ারম্যান, সদস্য এমনকি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, দোকানপাট-ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
গত রোববার কালাপাকুজ্যা ইউনিয়নে প্রথম সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। এখানে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পরাজিত ও বিজয়ী ইউপি সদস্য প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে ।এ ঘটনায় দুইপক্ষের চারজন আহত হয়। ৫ জুন রাতে গুলশাখালী ইউনিয়নে বিজয়ী চেয়ারম্যান আবু নাছিরের ওপর পরাজিত প্রার্থী আবদুর রহিম হামলা করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বাড়িঘর দোকানপাটে ভাঙচুর চালানো হয়।
একই রাতে গুলশাখালী ইউনিয়নে পরাজিত মহিলা সদস্য প্রার্থী কুলসুমা বেগমের লোকজন হামলা করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম কামালের ওপর। তার বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। পরের দিন ৬ জুন এ হামলার সূত্র ধরে কুলসুমা বেগমের আত্মীয়স্বজন মাইনীমুখের জারুলবাগান এলাকা থেকে দলবলে গুলশাখালী এসে তাণ্ডব চালায় । এ সময় গুজব ছড়ানো হয় মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল বারেক সরকারের ছেলে এরশাদ আলীকে বেঁধে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে বারেক সরকার তাঁর লোকজন নিয়ে গুলশাখালী যান এবং গুলশাখালীর পরাজিত চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রহিমের বাড়িসহ তার অনুসারীদের বাড়িঘর, দোকানপাটে ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর করেন বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী আবদুর রহিম ।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে গুলশাখালী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের বেশ কিছু দোকানে হামলার আলামত দেখতে পাওয়া যায়। টিনের দোকান, বসতবাড়িতে ভাঙচুরের চিহ্ন ছিলো স্পষ্ট। পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে ।
হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাইনীমুখ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল সরকার বলেন, ‘আমি যখন শুনতে পাই আমার এলাকার লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে গুলশাখালী যাচ্ছে, তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে আমিও গুলশাখালী যাই এবং গিয়ে আমার এলাকার লোকজনকে ফিরিয়ে আনি ।তবে উত্তেজিত লোকজন কয়েকটি বন্ধ দোকানের ঝাঁপিতে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে আমি তাদের লাঠি কেড়ে নেই। আমার লোকজন কাউকে মারধর করেনি।’
গুলশাখালির পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রহিম অভিযোগ করেছেন, ‘নির্বাচনের পরদিন আবু নাছেরের নেতৃত্বে আমার নেতাকর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা ও ভাঙচুর করে এবং পুরো গুলশাখালীতে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছে। আমার ভাগ্নে সুমনকে ডিপোর মুখে মারধর করে। পরদিন বারেক সরকারের নেতৃত্বে চৌমুহনী গুলশাখালী চৌমুহনী বাজারে তাণ্ডব চালায় সন্ত্রাসীরা। ভেঙে ফেলে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ। ৫০টি দোকানপাট ভাঙচুর করে লুটপাট চালায়। আমাদের বাড়িসহ পুরো গ্রামে হামলা করে নারী ও শিশুদের ওপর আক্রমণ চালায়।’
আবদুর রহিম বলেন, ‘বিএনপির নাছিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বারেক দেওয়ান যোগসাজস করে আমার সঙ্গে পুরোনো বিরোধের প্রতিশোধ নিচ্ছে।’ তিনি বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও দাবি করেন।
অন্যদিকে গুলশাখালী ইউপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আবু নাছের অভিযোগ করেছেন, ‘নির্বাচনের পরদিন থেকে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রহিম চেয়ারম্যানের লোকজন আমার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা করছে। বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে। এই কারণে আমি আত্মরক্ষার্থে গোপন একটি স্থানে ঠাঁই নেই এবং পরে রাঙামাটি চলে আসতে বাধ্য হই।’ নির্বাচনে যারা রহিম চেয়ারম্যানকে ভোট দেয়নি তাদের ওপরই রহিম চেয়ারম্যানের লোকজন আক্রমণ করছে এবং মারধর করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। মিথ্যা মামলার কারণে তাঁর নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছাড়া বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
৭ জুন আবারো হামলার ঘটনা ঘটে একই ইউনিয়নের সোনারগাঁও গ্রামে। এখানে বিজয়ী এক সদস্য প্রার্থী হামলা করে পরাজিত সদস্য প্রার্থীর লোকজনের ওপর । খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
৭ জুন উপজেলার ভাসান্যাদম ইউনিয়নে বিজয়ী ইউপি সদস্য প্রার্থী ইসমাঈল হোসেনের ওপর হামলা করে পরাজিত দুই সদস্য এবং অপর এক পরাজিত সদস্য প্রার্থীর লোকজন । হামলায় ইউপি সদস্য ইসমাঈল হোসেনের বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, বোনসহ চারজন আহত হয়। আহতের লংগদু স্বাস্থ্য কমপ্লক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত ইসমাঈল বলেন, ‘গত ৫ জুন আমার বাড়িতে হামলা চালানো হয় ।এ সময় আমরা পালিয়ে জীবন রক্ষা করি। পরেরদিন বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের জানালে তারা আমাকে আশ্বস্ত করে এবং এলাকায় ফিরে যেতে বলেন। আমি আমার পরিবারের লোকজন নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পথে আবার আক্রমণ করে আমাকেসহ আমার পরিবারের লোকজনকে আহত করে।’
পরপর বেশকিছু হামলা মারামারির ঘটনা সম্পর্কে লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। এত সুন্দর একটা নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর এমন সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রতিটি ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছি। পরাজিত চেয়ারম্যান, মেম্বাররা ভোটারদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে এমনটা করছেন বলেই মনে হচ্ছে। হামলার ঘটনায় গুলশাখালীর বিজয়ী চেয়ারম্যানসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরাজিত চেয়ারম্যান আবদুর রহিম ।’