কারাগারের নিরাপত্তা আছে আগের মতোই
মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়নকে ঘিরে সবারই চোখ এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিস্থিতি আছে আগের মতোই। এই ধরনের রায় কার্যকরের আগে জেলখানা ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া থাকে, বাড়তি তৎপরতা থাকে কারা কর্তৃপক্ষেরও।কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সারা দিন কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের চোখে এ ধরনের কোনো তৎপরতা ধরা পড়েনি। কারাগারের সামনে পুলিশ বা অতিরিক্ত কোনো নিরাপত্তাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানার জন্য সাংবাদিকরা বারবার চেষ্টা করেও কারা কর্তৃপক্ষ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পাননি।
কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের ব্যাপারে আজ সকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট কামারুজ্জামানের কাছে যাবেন।ম্যাজিস্ট্রেট কামারুজ্জামানের কাছে জানতে চাইবেন, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না। তাঁর সিদ্ধান্ত জানার পর পরবর্তী কার্যক্রম করা হবে।
আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরো জানিয়েছিলেন, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না, সে ব্যাপারে আজকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না চাইলে যত দ্রুত সম্ভব রায় কার্যকর করা হবে।
কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করতে বিলম্ব করা হচ্ছে কি না — জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ‘রায় কার্যকর করতে কোনো বিলম্ব করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে জেল কোড ও আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে।’
কিন্তু রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রাণভিক্ষার আবেদন জানতে কারাগারে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বা সংশ্লিষ্ট কাউকে ঢুকতে দেখেননি সাংবাদিকরা। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীর মোবাইলে ফোন করা হলে দুজনেরই নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন তাঁর আইনজীবী শিশির মনিরসহ পাঁচজন আইনজীবী। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা আলোচনার পর বের হয়ে আইনজীবী শিশির মনির ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, এ ব্যাপারে ভেবে দেখতে কামারুজ্জামান সময় চেয়েছেন। ওই সময় জামায়াত নেতাকে বিভিন্ন আইনি পরামর্শও দেন তাঁরা।
সিদ্ধান্ত না জানানো পর্যন্ত রায় কার্যকর করা যাবে না বলে উল্লেখ করে শিশির মনির বলেন, ভাবনা-চিন্তার জন্য একদিন, দুদিন, তিনদিনও সময় নিতে পারবেন তিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত না কামারুজ্জামান তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ রায় কার্যকর করা অনুচিত। আইনগতভাবেও এ রায় কার্যকর করা ঠিক হবে না।
ভেবে দেখতে কতদিন সময় চেয়েছেন কামারুজ্জামান—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, জেল কোড (কারাবিধি) অনুযায়ী রায় যেদিন হয়, এর পর থেকে আসামির সাতদিন পর্যন্ত সময় পাওয়ার কথা। গণমাধ্যমে এসেছে, তিনি ভেবে দেখার জন্য একদিন সময় চেয়েছেন। তবে এটা ঠিক নয়।
এদিকে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কমাতে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আজ বৃহস্পতিবার সংস্থাটির বহিঃপদক্ষেপ বিভাগ (এক্সটার্নাল অ্যাকশন) থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এমন আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ইউএনএইচসিএইচআর) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার আহ্বান জানানো হয়। এমনকি এ বিচার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে এবং এতে স্বচ্ছ বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ করে সংস্থাটি।
গতকাল বুধবার বিকেল ৪টা ৫২ মিনিটে হাইকোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে রায়ের অনুলিপি পৌঁছে দেন। এরপর বিকেল ৫টা ৫২ মিনিটে রায়ের অনুলিপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আফতাবউজ্জামানসহ পাঁচ কর্মকর্তা। এদিন কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডের রায় পড়ে শোনানো হয়।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার যাবতীয় প্রস্তুতি গত সোমবারই (৬ এপ্রিল) নিয়ে রেখেছেন তাঁরা। ওই দিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন।
২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত বছরের ৩ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। চলতি বছর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছায়। ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী সাতটি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।