কাঁটাতারের ফাঁকে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা
প্রতিবছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই বাংলার হাজার হাজার বাঙালি প্রাণের উচ্ছ্বাস আর আবেগ নিয়ে স্বজনদের সাথে মিলিত হয়েছেন পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের সীমান্তে। এক বছর অপেক্ষার পর আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁরা খুবই খুশি, উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তাদের দাবি, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে তাদের এই মিলনমেলাকে বাধাহীন করা হোক।
আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ৭৪৩ ও ৭৪৪ নম্বর মেইন পিলারের মধ্যবর্তী প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার জেলার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। এ মিলনমেলা চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
সকাল থেকেই দুই বাংলায় মানুষ সীমান্তের গ্রামগুলোতে জড়ো হতে থাকে। বেলা ১১টায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স-বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি আগন্তুকদের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মানুষজন নো-ম্যান্স ল্যান্ডে (শূন্যরেখায়) ছুটে আসেন। এ সময় বিজিবির অমরখানা ক্যাম্প এবং বিএসএফের খালাপাড়া ক্যাম্প সদস্যরা পরস্পরের মধ্যে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অমরখানা সীমান্তে দুই বাংলার মানুষ আত্মীয়স্বজনদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত খুঁজে বেড়ান। প্রিয়জনকে খুঁজে পেয়ে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে মানুষ মেতে ওঠেন কথোপকথন আর খোশগল্পে। আবেগে আপ্লুত হয়ে আনন্দে অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়। অন্যরকম দৃশ্যের অবতারণা হয় সীমান্তজুড়ে। অনেকেই বাড়ি থেকে প্রিয় মানুষটির জন্য খাবার আর উপহারসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগে পঞ্চগড়ের সদর, তেঁতুলিয়া, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে ছিল। দেশ বিভাগের এসব এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় আত্মীয়-স্বজনরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই দেশে ছিটকে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুই দেশের আত্মীয়-স্বজনরা একে-অপরের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ পেলেও ভারত তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পর অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। পাসপোর্ট করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভারত বা বাংলাদেশে যাতায়াত করে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মানুষের কাছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে বিজিবি ও বিএসএফের সহযোগিতায় বেশ কয়েক বছর ধরে অমরখানা সীমান্তে দুই বাংলার এই মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বোদা উপজেলা শহরের সুলতানা বেগম ভারতের শিলিগুড়িতে থাকা ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ভাইদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। ভাইদের পোলাও-মাংস-ইলিশ মাছ দিয়েছেন। দেখা করে এসব দিতে পেরে আনন্দিত তিনি।
জেলা শহরের ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সেকেন্দার আলী জলপাইগুড়িতে থাকা বোনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। দেখা পেয়ে তিনি খুশি। পহেলা বৈশাখের এই মিলনমেলার দিনটির জন্য তিনি অধীর অপেক্ষায় থাকেন।
কাঁটাতারের বাইরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা ভারতের অভ্যন্তরে গিয়ে আরো কাছাকাছি দেখা করা ও সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য উভয় দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ জানান এই শিক্ষক।
জেলা শহরের ইসলামবাগ এলাকার রিফাত সামস রায়হান হৃদি বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের মিলনমেলার কথা শুনে সীমান্তে এসেছেন দেখতে। একসঙ্গে এত মানুষের মিলিত হওয়া দেখে তিনিও খুবই খুশি।
অমরখানা এলাকার বৃদ্ধ জহির উদ্দিন (৭০) জানান, ‘আমি গরিব মানুষ। বাবারে, ভারতে গিয়ে ভাই-বোনদের দেখা করার উপায় নাই। পাসপোর্ট ভিসাও করিবার পারি না। পহেলা বৈশাখে কাঁটাতারের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ভাই-বোনদের সাথে দেখা করি। দূর থেকে দেখে মনটার শান্তি হয়।’
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আরিফুল হক এনটিভিকে বলেন, প্রতিবছর এখানে উভয় দেশের নাগরিকদের মিলনমেলা হয়ে থাকে। দুই দেশের নাগরিকরা যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়, এ জন্য আমরা বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করে এই মিলনমেলার আয়োজন করি। বছরে এই একটি দিন উভয় দেশের নাগরিকদের একটা বিরাট পাওনা। মিলনমেলাটি সুষ্ঠু সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।