এখনো অজ্ঞাতপরিচয় লাশ ২১, নিখোঁজ ৬৪
আজকের এই দিনে পদ্মায় ভয়াবহ নৌ-দুর্ঘটনায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। সরকারি হিসাবে, এতে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ থাকে ৬৪ জন। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ২১ জনকে মাদারীপুরের শিবচর পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। দুই বছরেও তাদের কারো পরিচয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মাটির সঙ্গে গলে-পচে যায় পরিচয়টুকুও। হদিসও পাওয়া যায়নি দুর্ঘটনার শিকার পিনাক-৬ লঞ্চটির।
সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬। ৪৯ জনের লাশ বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্ধার করে শিবচরের পাঁচ্চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয়। নিখোঁজ থাকেন আরো ৬৪ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে অন্তত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। স্বজনদের না পেয়ে এ সব পরিবারে চলছে এখনো শোকের মাতম। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ২১ জনকে শিবচরের পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রথম লাশটি উদ্ধার হয় হীরার। এর দুদিন পর লাকীর লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ থাকেন স্বর্ণা। পিনাক-৬ লঞ্চে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে শিবচরকে বিদায় জানিয়ে ফেসবুকে সেলফি দিয়েছিলেন শিকদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রী নুসরাত জাহান হীরা। স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘গুড বাই শিবচর।’ এঁদের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে।
শুধু হীরাই নয়, তাঁর সঙ্গে শিবচরকে চিরবিদায় জানালেন তার ছোট বোন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা ও খালাত বোন চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ও শরীয়তপুরে গঙ্গানগর এলাকার জান্নাতুল নাঈম লাকী। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের পরিবারে আজও চলছে শোকের মাতম। নিখোঁজদের পরিবারগুলোর দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।
নিখোঁজ হীরা ও স্বর্ণার বাবা মো. নূরুল হক মিয়া বলেন, ‘দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেল। ভাবতে পারিনি একসঙ্গে তিন মেয়েকে হারাতে হবে। নিয়তির কাছে সবকিছুই হার মানে।’
এ ছাড়া শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধা রিজিয়া বেগমের এক ছেলে মিজানুর রহমান, পুত্রবধূ রোকসানা বেগম, আড়াই বছর বয়সের নাতি মাহিন এবং ১১ বছর বয়সের নাতনি মিলিসহ একই পরিবারের চারজন নিহত হন। লঞ্চডুবিতে একই পরিবারের চারজনকে হারিয়ে ওই পরিবারের কর্তা বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম কিছুদিন আগে মারা গেছেন। যেসব পরিবারে এখনো স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি সাহায্য। এরপর আর কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। যেসব পরিবারে এখনো স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি সাহায্য। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপন। কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। এতে ক্ষোভের অন্ত নেই স্বজনহারা পরিবারগুলোতে। যদিও নিহতদের তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার করে টাকা ও পরে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। ঘটনার পর লৌহজং ও শিবচরে স্থাপন করা হয় অভিযোগ ও তথ্যকেন্দ্র।
বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের সংসারে চারজন মারা গেছে ওই লঞ্চে। তিনজনের লাশ পাইছি। নাতনির লাশ আজও পাই নাই। এই ছেলেই ছিল আমার সংসারের আলো। ওর শোকে শোকে ওর বাপও কয়দিন পরই মারা গেছে। আমি এহন জ্যান্ত লাশ।’
সপরিবারে নিখোঁজ ফরহাদের ছোট ভাই শিশু মিয়া বলেন, ‘একটা লাশ পাইলেও মনডারে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আর সরকার টাকা তো দূরে থাক একটা খবরও নেয় নাই।’
এদিকে, ২১ অজ্ঞাত লাশের আজও পরিচয় দিতে কেউ আসেনি। শিবচর পৌর কবরস্থানে শায়িত রয়েছে পরিচয়হীন এসব ব্যক্তি। মাঝে মাঝে পৌরসভার এক কর্মচারী কবরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। বাকি সময় স্থানীরাও দোয়া পড়েন।
কথা হলো স্থানীয় সেকেন্দার আলীর (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার লোকজন এখানে দাফন করেছি। তাদের জন্য দোয়া করি। সাথে এই অভাগোর জন্যে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি। এমন মৃত্যু যেন আর কারো না হয়।’
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনছার উদ্দিন জানান, এ ঘটনায় কাওরাকান্দি ঘাটের ইজারাদার আবদুল হাই শিকদার, পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বকর কালু মিয়া ও তাঁর ছেলে লিমনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর লঞ্চের মালিক কালু মিয়া ও তাঁর ছেলে লিমনকে গ্রেপ্তার করা হলেও লিমন জামিনে বেরিয়ে আসেন। তবে যেসব মৃতদেহের ডিএনএ টেস্ট রয়েছে, তাদের স্বজনরা যদি আসে, যথাযথ প্রমাণসাপেক্ষে দেহাবশেষ দেওয়া হবে।’
মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. দিলীপ কুমার জানান, ‘বেওয়ারিশ ২১ জনের ডিএনএ টেস্ট রাখা আছে। যদি কেউ আসে, তাদের সঙ্গে মিল দেখে মৃতদেহ দিতে পারব।’
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন বিশ্বাস জানান, উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ২৭ জনের পরিবারকে এক লাখ ৫ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে। বাকিদের শনাক্ত করা গেলে তাদের পরিবারকেও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে।
ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কারণে পদ্মায় দলিত সমাধি হয়েছিল দুই শতাধিক তরতাজা প্রাণ। তবে এখনো থেমে থাকেনি লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই। নৌ-কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ দাবি কাওরাকান্দি-শিমুলিয়া নৌ-রুটে যাতায়াতকারী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রীদের।