২১ আগস্টের হামলা : ভালো নেই হতাহতদের স্বজনরা
‘আমার বাবা বলেছিল, মা তোমার পেটের পাথর অপারেশন করাব। ১০টা দিন অপেক্ষা করো। নয়দিনের মাথায় ছেলে ফিরেছে, লাশ হয়ে।’
আছিয়া বেগমের চোখ দিয়ে কেবলই পানি ঝরছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আছিয়ার ছেলে লিটন মুন্সি। যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সেখানেই কথা হয় লিটনের মায়ের সঙ্গে।
ওই ঘটনায় মাদারীপুরের আরো তিনজন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। নিহতদের স্বজনরা ও আহতরা কেউই ভালো নেই। মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁরা।
গ্রেনেড হামলায় নিহত হন শ্রমিক লীগ নেতা নাসিরউদ্দিন। তাঁর বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামে। গ্রেনেড হামলায় নিহত অপর ব্যক্তি যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তাঁর বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামে। নিহত হন সুফিয়া বেগম নামের এক নারী। তিনি রাজৈরের বাসিন্দা ছিলেন।
কথা হয় নিহত সেন্টুর স্ত্রী আইরিন পারভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওকে হারিয়ে আমরা পথে বসে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমভাবে বেঁচে আছি।’
এ জেলায় একাধিক ব্যক্তি আছেন যাঁরা ওই হামলায় আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন, কিন্তু মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ১২ বছরেও ওই হামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার চরম ক্ষুব্ধ।
রামকৃষ্ণ মণ্ডল পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তাঁর ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো আর্থিক অনুদান পাননি রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণর চার মেয়ে ও দুই ছেলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় রামকৃষ্ণের তিন মেয়ের বিয়ে হলেও বর্তমানে এক মেয়ে দশম শ্রেণি ও দুই ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। অভাবের মধ্যেই চলছে রামকৃষ্ণর সংসার। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী রামকৃষ্ণ গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে প্রায়ই অসুস্থ হওয়ার কারণে নিয়মিত কাজ করতে পারেন না। এ ছাড়া তাঁর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন বলে রাম কৃষ্ণ জানান। চোখ হারানো রামকৃষ্ণ পাননি সামান্য স্বীকৃতিটুকুও।
গ্রেনেড হামলায় আহত রামকৃষ্ণ সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা চান, চান স্বাভাবিক জীবনযাপন। তিনি সরকারি সহায়তার দাবি করেন।
গ্রেনেড হামলায় আহত সাইদুল ইসলাম কালকিনি পৌরসভায় ডিস লাইনের ব্যবসা ও কবির হোসেন কালকিনিতে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। সাইদুল ও কবির একবার সরকারিভাবে সামান্য অনুদান যা পেয়েছেন তা দিয়ে ব্যবসা করে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান। দুজনের শরীরেই আছে বোমার স্প্লিন্টার। দুজনেরই প্রয়োজন চিকিৎসার। কিন্তু তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
সাইদুল ইসলাম মাথায়, বুকে ও হাতে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের কারণে ভারী কাজ করতে পারেন না। সাইদুল বলেন, ‘এখনো সেই ভয়াল স্মৃতি মনে পড়লে ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ করলেই ভাসে ২১ আগস্টের ভয়াল চিত্র। তখন আর ঠিক থাকতে পারি না। ভয়ে শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। চিৎকার করে উঠি। আর বলতে থাকি, কে আছো, আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।’
কবির হোসেনের বাঁ হাত ধীরে ধীরে অচল হয়ে যাচ্ছে। তরকারি বিক্রি করে জীবন চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁর।
অপরদিকে কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে। হালান ঢাকার মিরপুরে মুরগির ব্যবসা করেন বলে জানা যায়।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক কামালউদ্দিন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের সাহায্যে তিনি পদক্ষেপ নেবেন।