আজ ২১ আগস্ট, ভয়াবহ হামলার ১২ বছর
ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী আজ। ১২ বছর আগে ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে।
জাতি আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে দিনটি পালন করবে। যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ রোববার বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করবেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, সংসদ সদস্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা এ সময় উপস্থিত থাকবেন।
পরে একই স্থানে শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনা সভায় অংশ নেবেন।
ওই হামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও ২৪ জন নিহত হন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের শান্তি সমাবেশে বিকেলে একটি ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে যখন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আকস্মিক এই হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান এবং আরো ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত হন।
এ ছাড়া এই হামলায় আরো ৪০০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে এ হামলা করা হয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে অভিযোগ করেছিলেন দলটির নেতারা।
ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ অন্য নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে এক মানববলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে তাঁকে গ্রেনেড ও গুলির আঘাত থেকে রক্ষা করেন। এদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
গ্রেনেড হামলায় দলের নিহত নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন আইভি রহমান, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুন্সি, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসহাক মিয়া।
মারাত্মক আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।
অভিযোগ আছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয়, এ হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পাঁচটি গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
হামলার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামের এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে আটক করা হয়। অথচ পরবর্তী তদন্তে তাঁদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুকূল পরিস্থিতিতে সরকার এ হামলার পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিলে এবং সাড়ে তিন বছর পর বিলম্বিত পুলিশ চার্জশিট নথিভুক্ত করা হয়। অথচ বিএনপির কতিপয় সংসদ সদস্য এই জঘন্য হামলাকে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হামলা বলে দাবি করেছিলেন।
পুনরায় তদন্তে পুলিশ এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ জনকে চিহ্নিত করে।
অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান কারাগারে রয়েছেন।
এই মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছেন।
পলাতকদের মধ্যে তারেক রহমান রয়েছেন লন্ডনে, শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ ব্যাংককে, হানিফ এন্টারপাইজের মালিক মোহাম্মদ হানিফ কলকাতা, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোরসালীন ও তার ভাই মহিবুল মুত্তাকিন ভারতের একটি কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর ও মাওলানা লিটন ওরফ জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ডিএমপির তৎকালীন উপকমিশনার (পূর্ব) ও উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসানও বিদেশে অবস্থান করছে।
তবে সাবেক অভিযুক্ত হারিছ চৌধুরীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু আটক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই।
বেশ কয়েকটি বিদেশি মিশন যেমন ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ইন্টারপোল বাংলাদেশি তদন্তকারীদের যোগ দিলেও এসব প্রতিষ্ঠান বিএনপি সরকার তাদের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছিল।
এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বাসসকে বলেছেন , ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। জাতি দীর্ঘ প্রত্যাশিত এই মামলার রায় তিন মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন বলে তিনি আশা করেন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, দুজন তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জেরা সম্পন্ন হলেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দেওয়া হবে এবং এ জন্য প্রয়োজন দুই থেকে তিন মাস।
৪৯১ জনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ২২৪ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্পন্ন হওয়ায় মোশাররফ এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।