বরেন্দ্র জাদুঘরে হাজার বছরের স্মৃতি
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/18/photo-1431919113.jpg)
ইতিহাস-ঐতিহ্য আর স্থাপত্যশিল্পকে ধারণ করে টিকে থাকে একটি জাতি। বাঙালিও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। বাঙালির এই ঘরানার শিল্পের সবচেয়ে বড় সম্ভার বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য বাইরের দুনিয়ায়ও স্বীকৃতি রয়েছে এর। দেশের একমাত্র এই গবেষণা জাদুঘর রয়ে গেছে অনেকটা অগোচরে।
শতবর্ষ ছুঁয়ে যাওয়া এই জাদুঘরের মূল ফটকে প্রবেশ করেই দেখা যাবে তীরচিহ্ন সাইনবোর্ডে লেখা ‘জাদুঘর ও লাইব্রেরির প্রবেশপথ’। ওই পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি টিকেট কাটতে হবে। শুরু সেখান থেকেই।
১৩টি গ্যালারিতে থাকা হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য দেখার সুযোগ মিলবে। জাদুঘরে প্রস্তর, ধাতব, পোড়ামাটির ভাস্কর্য, শিলালিপি, তাম্রলিপি, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, তৈজসপত্র এবং পুরোনো দলিলের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৯০০। এর মধ্যে আধুনিক পদ্ধতির আলোকসম্পাত দিয়ে পুরাকীর্তিগুলোর নান্দনিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এতে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসনামলের স্থাপত্যশিল্প ও চিত্রকর্মের বড় সম্ভার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, পারস্য ও বাংলার পাণ্ডুলিপি, হাতে লেখা এক-দেড় ইঞ্চির কোরআন শরিফ, সংস্কৃতি ও প্রাকৃত পাণ্ডুলিপি, মোগল চিত্রকর্ম, পাথর ও ব্রোঞ্জের নির্মিত অস্ত্র, বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার প্রস্তর মূর্তি, আধুনিক কাঠের স্থাপত্য, শিব, গণেশ ও বিষ্ণুর নানা দলনৈল মূর্তি, দুর্গা, গৌরী, উমা ও পার্বতীর মূর্তি, বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা ও তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণ। এ সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে দামি হলো ১২শ শতকের কালো পাথরের একটি গঙ্গামূর্তি। এসবের প্রায় সবই মহেঞ্জোদারো থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের গ্রন্থাগারও বেশ সমৃদ্ধ। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ক বহু দুর্লভ গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীসহ এর বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এর মধ্যে বাংলা ও সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। তাই দেশি-বিদেশি গবেষকদের জন্য একটি নিশ্চিন্ত ও নির্ভরযোগ্যতার মর্যাদা লাভ করেছে।
১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটির ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপ্টাও কম যায়নি। কলকাতা জাদুঘর ১৯১১ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের যাবতীয় সংগ্রহ দাবি করে বসে। তবে সে ঝামেলা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পরে দেশভাগের পর আবারো হুমকির মুখে পড়ে প্রাচীন এই জাদুঘর। ১৯৬৪ সালে জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গৃহীত হয়। এখনো এটি রাবির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
জাদুঘরটি সরেজমিনে ঘুরতে গিয়ে দারোয়ানকে বলতে শোনা যায়, ‘বন্ধের দিন মানুষ বেশি আসে।’ তাই কেউ যেন জাদুঘরটি দেখতে গিয়ে ঘুরে না আসে, সে জন্য পরিদর্শনের সময়সূচি জানা থাকা দরকার। দর্শনার্থীরা শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা, শুক্রবার ২টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দেখতে পারবে। শুধু বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে।
এর একপর্যায়ে দেখা হয় কক্ষবাহক আবদুল ওয়াকিলের সঙ্গে। ওই সময় তাঁকে দেখা যায় দর্শনার্থীদের ‘আবহমান বাংলাদেশ’-এর মর্মার্থ বর্ণনা করতে। তিনি বলেন, ‘নদীর ওপর ওই যে লাল সূর্যটি, তা অস্ত যাচ্ছে। এটি নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত রূপ। আর ওই যে চৌদ্দটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, ওগুলোরও তাৎপর্য আছে। একসময় ভারতবর্ষে ১০৮ থেকে ১১২ ধরনের নৌকা ছিল। আর এই চৌদ্দটা নৌকা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ওই তাৎপর্যই বহন করে।’ এভাবেই তিনি দর্শনার্থীদের সুন্দর করে বিষয়গুলো বুঝিয়ে থাকেন। ‘আমায় ভাসাইলো রে আমায় ডুবাইলো রে’ গানটির টান দিয়ে বলেন, ‘এই গানটি আমরা বাজাই। কিন্তু যান্ত্রিক সংকটের কারণে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না।’
আবদুল ওয়াকিলের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আরো কয়েকটি সংকটের কথাও বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত গ্যালারি নেই। যে সংগ্রহ রয়েছে, তা এ রকম আরো কয়েকটা বিল্ডিং হলেও প্রদর্শন সম্ভব নয়। আমাদের নিরাপত্তা সমস্যাও রয়েছে।’
এ ব্যাপারে জাদুঘরের উপপরিচালক মনিরুল হক বলেন, ‘নিরাপত্তা সমস্যা তো অবশ্যই আছে। আমাদের একজন আর্ম গার্ড ছিল, এখন তাও নেই। আর গ্যালারি সংকট তো আছেই। তবে আমরা যা দেখাব, ভালো দেখাব। আমাদের এই জাদুঘর মাল্টিপারপাস। আর এই ঘরানার জাদুঘরে মোট সংগ্রহের ২৫ ভাগ দেখানো হয়। এখন যা প্রদর্শিত হচ্ছে, একসময় তা পরিবর্তন করে অন্যগুলো আনা হবে। এভাবে সব সংগ্রহই দেখানো হয়ে থাকে।’
ভ্রমণপিপাসু, গবেষক কিংবা শিল্পপ্রেমীরা চাইলে ঘুরে আসতে পারেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘরটি। এ জন্য ট্রেন বা বাসে করে রাজশাহী পৌঁছে অটো বা রিকশায় করে সহজেই যাওয়া যায় নগরীর হেতেম খাঁ এলাকায় অবস্থিত জাদুঘরে। থাকার জন্য রয়েছে শহরে ভালো মানের হোটেল।