শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি ঠেকাতে করণীয় কী?
ইন্টারনেটের কারণে শতকরা ৮৫ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যায় পড়েছেন৷ এছাড়া ইলেট্রনিক ডিভাইসের কারণে প্রায় ৭১ ভাগ শিক্ষার্থী নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হন৷ আর ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আসক্তি অনুভব করেন৷
‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের জরিপে এই তথ্য জানিয়েছে৷ তাদের জরিপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক গেজেটও অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ তবে তাদের এই জরিপ নিয়ে প্রশ্নও আছে৷ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ধারণা৷ বাস্তবে সংখ্যাটা এত বেশি না-ও হতে পারে৷
প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশের এক হাজার ৭৭৩ জন শিক্ষার্থী শিক্ষার্থীর মধ্যে জরিপ চালায়, যাদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷ এরমধ্যে নারী ৪৯ দশমিক ৫ এবং পুরুষ ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ৷ তৃতীয় লিঙ্গের শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়৷
বিশ্লেষকেরা বলেন, ‘ইন্টারনেট ভিত্তিক যত প্রোডাক্ট তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোর টার্গেটই হলো আসক্ত করা৷ তাই এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সবার আগে সচেতন হতে হবে৷ কারণ ইন্টারনেট মানুষের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে গেছে৷ এটা বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই৷ তাই এখন দরকার ইন্টারনেট লিটারেসি৷’
জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তারা তাদের জীবনে কখনও না কখনও মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন৷ এই মানসিক সমস্যার জন্য ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটকে দায়ী করেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের তরুণদের ব্যস্ত রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা আমরা রাখছি না৷ বিনোদন বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোরও এখন তেমন সুযোগ নাই৷ ঢাকা শহরে খেলার মাঠ নেই। ফলে তরুণরা ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে৷ এটা একসময় তাদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করে৷ তারা বাস্তব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে উঠছে৷ এতে তাদের মানসিক এবং শারীরিক দুই ধরনের সমস্যাই হচ্ছে৷’
এই অধ্যাপক মনে করেন, এই জরিপে যদি ৪০ থেকে ৫৫-৬০ বছরের নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হতো তাহলে ভিন্ন আরেকটি চিত্র পাওয়া যেত৷ যা থেকে এই ইন্টারনেট আসক্তির কারণ বের করা সহজ হতো।
জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ পড়াশোনার কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও পড়াশোনাসহ দরকারি কাজের চেয়ে বিনোদন বা সময় কাটানোর জন্যই শিক্ষার্থীরা বেশি সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করেন৷ তারা দিনের বড় একটি সময় অনলাইনে থাকছেন৷ সর্বোচচ ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দিনে পাঁচ-সাত ঘণ্টা ইন্টারনেটে থাকেন৷ পড়াশোনার ফাঁকে অনলাইনে গেলে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশের পড়াশোনার মনোযোগ হারিয়ে যায়৷ ৩১ দশমিক ২ শতাংশের পড়াশোনায় অনীহা জন্ম নেয়৷
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানসেন রোজ বলেন, ‘আমরা গভীর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখতে পেরেছি৷ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া৷ পড়াশোনা ছেড়ে অন্য নেতিবাচক কাজে যুক্ত হয়ে পড়া৷ একটি কল্পনার জগতে বাস করার প্রবণতা, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ আছে শারীরিক নানান প্রতিক্রিয়া৷ রাত জেগে ইন্টারনেটে থাকলে তার তো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হবেই৷’
তানসেন রোজ বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করার শুরুতেই একজনকে এসব দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে৷ কারণ ইন্টারন্টে ছাড়া তো আমরা চলতে পারব না৷ তাই এর ভালো ও খারাপ দিক সম্পর্কে খোলাখুলি সন্তানদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে৷’
ইন্টারনেটের কারণে ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করেন ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাদের পড়াশোনার ক্ষতি করছে৷ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ ইন্টারনেটে পর্ন দেখা, সাইবার ক্রাইম, বাজি ধরা ও বুলিংসহ অপ্রীতিকর কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছেন৷ ২৩ শতাংশ অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন, ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেছেন এবং ২০ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন৷
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাদের বাস্তব জীবনের পাশাপাশি আরেকটি ভার্চুয়াল জগৎ তৈরি হয়েছে৷ ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, মন খুলে কথা বলার মতো মানুষ পাচ্ছেন না ৷ এছাড়াও ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তারা এর প্রভাবে সামাজিকভাবে মিশতে পারছেন না৷
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে ইন্টারনেট ভিত্তিক পণ্যগুলো মানুষকে আসক্ত করতেই তৈরি করা হয়৷ ফেসবুক চায়, সারাক্ষণ এটা মানুষ ব্যবহার করুক৷ কারণ এটা তাদের ব্যবসা৷ ইনস্টাগ্রাম চায়, সারাক্ষণ মানুষ ছবি ও ভিডিও আপলোড করুক৷ তাহলে তাদের ব্যবসা বাড়বে৷ মানুষকে আসক্ত করতে তারা অর্থ বিনিয়োগ করে গবেষণা করে৷’
জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘এই ব্যবসার কনজিউমার এন্ডে (ভোক্তা পর্যায়ে) আছি আমরা৷ তাই আমরা যদি এর ভালো এবং ক্ষতির দিক না বুঝতে পারি, তাহলে তো আমাদের সমস্যা হবেই৷ পরিবারের বড়রাই যদি ইন্টারনেটে আসক্ত হন, তাহলে তরুণদের সচেতন করবেন কীভাবে? মুখের কথায় তো কাজ হবে না৷ তারা তো দেখে শেখে৷’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন ইন্টারনেটের প্রভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোগী বেশি পাচ্ছি৷ দিন দিন এর নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে৷ এরমধ্যে পড়াশোনা ও কাজের প্রতি অনাগ্রহ, বাস্তব জীবন নিয়ে ভয়—এগুলো রয়েছে৷ যারা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তাদের মধ্যে স্বাভাবিক যৌনস্পৃহা কমে যাচ্ছে৷’
অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আঁচল ফাউন্ডেশনের যে জরিপ তা স্বেচ্ছা মতামতের ভিত্তিতে করা৷ তারা বলছেন, তারা আসক্ত বলে নিজেদের মনে করছেন৷ কিন্তু বাস্তবে সেটা না-ও হতে পারে৷ কারো মানসিক সমস্যার কারণ হয়তো অন্যকিছু, কিন্তু সে ভাবছে ইন্টারনেট৷ ফলে সংখ্যাটা অনেক বেশি মনে হচ্ছে৷ বাস্তবে এটা না-ও হতে পারে৷ তবে আমাদের সচেতন হতে হবে৷’
অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই খারাপ, তা কিন্তু নয়৷ এটা আমাদের প্রয়োজন৷ তাই দরকার ইন্টারনেট লিটারেসি৷ এটা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবার কাজ৷’
আর কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘কেউ ইন্টারনেটে আসক্ত হলেও তাকে তা থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কাউন্সেলিংসহ আরও কিছু ব্যবস্থার মাধ্যমে৷ তবে সবার জন্য একই প্রক্রিয়া নয়৷ আমরা আসক্তি দেখে একেকজনের জন্য একেক রকম পদ্ধতি কাজে লাগাই৷’