বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো ভূমিকা দাবি
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়নের অভিযোগ ও আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো ভূমিকা চায় মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্যানেল বক্তারা। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা তদন্ত করে সরকার নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না বলে মনে করেন প্যানেলের বক্তারা।
গত মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) কমিশনের ‘হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ : অ্যান আপডেট’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল ব্রিফিংয়ে প্যানেল বক্তারা এসব কথা বলেন।
প্রতিনিধি পরিষদের এই সংস্থা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রচার, সুরক্ষা ও সমর্থনে কাজ করে। ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট সদস্য জেমস পি ম্যাকগভর্ন ও রিপাবলিকান সদস্য ক্রিস্টোফার এইচ স্মিথ। তারা এই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান। ব্রিফিংটি সঞ্চালনা করেন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের বিদেশি আইনবিশেষজ্ঞ তারিক আহমেদ।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন অ্যান্ড এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ফেলো ক্রিস্টি উয়েদা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্ল্যাকনার ও যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামসের ভিজিটিং এক্সপার্ট জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড।
ব্রিফিংয়ের শুরুতেই সঞ্চালক তারিক আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দেশটি রেকর্ড সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য কমিয়েছে। চার দশকের মধ্যে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূতকরণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন।’
বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক-দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো গত এক দশকে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের কথা সামনে এনেছে। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, সাংবাদিক-ব্লগারদের নিপীড়নসহ বাক্-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট–স্বাধীনতা সীমিত করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। দেশটিতে সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী, ব্লগারদের গ্রেপ্তার-বিচারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বিশেষভাবে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ব্রিফিংয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্ল্যাকনার বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব তৈরি হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম তাৎক্ষণিকভাবে কমে এসেছে। কিন্তু, এখনও লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বেআইনিভাবে আটকে রাখা হচ্ছে। পরে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বা আদালতে হাজির করা হচ্ছে। কারা হেফাজতে নির্যাতনের কথাও শোনা যাচ্ছে।’
জুলিয়া ব্ল্যাকনার বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম কমে যাওয়া এই বার্তা দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ সরকার চাইলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে পারে। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্নকারী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তবে, দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সহিংসতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন।’ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে যে দাবি করছে, তা বিশ্বাস না করতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্যে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন অ্যান্ড এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের মতোই অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। যদিও র্যাব ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব দেখা গেছে। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছে।’
আশরাফুজ্জামান বলেন, পরিসংখ্যান বলছে, এই নিষেধাজ্ঞা অনেক জীবন বাঁচাতে সহায়ক হয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। জনগণ ভোট দিতে উন্মুখ। কিন্তু, একটি বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিকে সরকার কঠিন করে তুলেছে। বাংলাদেশিদের যে মূল্য গুনতে হচ্ছে, তার মাত্রা কমিয়ে আনতে হিউম্যান রাইটস কমিশনকে পূর্ণ শক্তি ব্যবহারের আহ্বান জানান তিনি।
রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ফেলো ক্রিস্টি উয়েদা লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, ঠিক তেমনি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার নাগরিক অধিকার সংকুচিত করে চলেছে। তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদের নিশানা করেছে। এসব মানুষ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিহিংসামূলকভাবে গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতির শিকার হচ্ছেন। মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে।’
ক্রিস্টি উয়েদা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর কাজকে আক্রমণ-অসম্মান অব্যাহত রেখেছে। সরকার সংগঠন ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তে বাংলাদেশ সরকার নিরপেক্ষ ও কার্যকর জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না। বরং, একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত অন্যান্য বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে নাগরিক স্বাধীনতার সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’
জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক দেশটির সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮ সালের) খুবই ত্রুটিপূর্ণ, সহিংসতাপূর্ণ ও অনিয়মে ভরা ছিল বলে মনে করেন। যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।’