বাংলাদেশে জাহাজ-ভাঙা শিল্প যেন অনিয়মের এক আখড়া
বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রামের আরেফিন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি শিপইয়ার্ডে ম্যাক্স নামের ২৪ বছরের পুরোনো এক জাহাজ ভাঙার কাজ করছিলেন মোহাম্মদ বিপ্লব। কাজের প্রয়োজনে একদিন ইঞ্জিন রুমে পাইপ দিয়ে আগুন ধরানোর সময় তা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে পেছনের দেয়ালে ছিটকে পড়েন বিপ্লব। তার মুখ মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় এবং পিঠ ভেঙে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। সামান্য জ্ঞান ফেরার পর বিপ্লব বুঝতে পারেন সহকর্মীরা তাকে রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে। এই আঘাতের চিকিৎসার জন্য বিপ্লবকে নিজের সব জমিজমা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে এখন একটি চায়ের দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন বিপ্লব।
আরেফিন এন্টারপ্রাইজ নামের যে প্রতিষ্ঠানে বিপ্লব কাজ করতেন তা মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজ কিনে নিয়ে সেগুলো ভাঙার কাজ করে। পরে তারা ধাতব এবং অন্যান্য উপকরণ বিক্রি করে, যা ব্যবসা হিসেবে যথেষ্ট লাভজনকই মনে করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই জাহাজ-ভাঙা শিল্পের বার্ষিক অবদান আনুমানিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইস্পাতের অর্ধেকেরও বেশি আসে চট্টগ্রামের এই শিল্প থেকে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, বাংলাদেশের এই জাহাজ ভাঙা শিল্প নানা অনিয়মের আখড়া। আরেফিন এন্টারপ্রাইজ বিপ্লবের ৮ দিনের জরুরি চিকিৎসার খরচ বহন করে, যা প্রায় ১৬০ মার্কিন ডলার। অথচ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তার পাওয়ার কথা ২,০০০ ডলারের কাছাকাছি।
তবে আরেফিন এন্টারপ্রাইজই শুধু নয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বিপ্লব বলেছেন, তার এই দুরবস্থার জন্য যে জাহাজটি তিনি ভাঙছিলেন সেই ম্যাক্সের মালিককেও দায়ী করা উচিত। ম্যাক্স এর আগে গ্রিক শিপিং কোম্পানি টাইড লাইন ইনকর্পোরেটেডের মালিকানাধীন ছিল এবং ইউরোপের আইন অনুসারে ভাঙার জন্য এটির বাংলাদেশে আসারই কথা ছিল না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন অনুসারে এর পতাকাবাহী জাহাজগুলো তাদের অনুমোদিত শিপ ইয়ার্ড ছাড়া অন্য কোথাও ভাঙার সুযোগ নেই। কিন্তু এই ধরনের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো শিপইয়ার্ড বাংলাদেশে নেই। এই নিয়মকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পুরোপুরিভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা দেওয়ার আগে ম্যাক্সকে অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় ২০২১ সালের জুনে। সেই মাসেরই শেষের দিকে ভাঙার জাহাজটি বাংলাদেশে আমদানির অনুমতি পায়। এটি ২০২১ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এক মাসের বেশি সময় পরে এতে বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে বিপ্লব আহত হন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, অনেক ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানি জেনে-শুনে বাংলাদেশে বিপজ্জনক ও দূষণকারী ইয়ার্ডে ভাঙার জন্য তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজগুলো পাঠাচ্ছে।
‘ট্রেডিং লাইভস ফর প্রফিট’ শীর্ষক ৯০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে কীভাবে আইনের ফাঁক গলে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতে বিষাক্ত জাহাজ ভাঙা হচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জাহাজ-ভাঙা শিল্পগুলো প্রায়ই নিরাপত্তা নিয়ে ‘শর্টকাট’ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সৈকত ও আশেপাশের পরিবেশে সরাসরি বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে দেয় এবং আহত হলে শ্রমিকদের মজুরি, বিশ্রাম বা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করে। প্রতিবেদনটিতে জাহাজ মালিকদের একটি চক্রকেও তুলে ধরা হয়, যারা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মতো যেসব স্থাপনায় পর্যাপ্ত পরিবেশগত বা শ্রম সুরক্ষা নেই, সেসব স্থাপনায় ভাঙার জন্য জাহাজ রপ্তানি করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২০২০ সালে করোনার পর জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশই বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় গন্তব্য। গত তিন বছরে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ৫২০টিরও বেশি জাহাজ ভাঙার কাজে জড়িত ছিলেন, যা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এই প্রতিবেদন তৈরিতে ৪৫ জন জাহাজ-ভাঙা শ্রমিক, শ্রমিকের আত্মীয়-স্বজন, ১০ জন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-কে উদ্ধৃত করে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজ-ভাঙা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। শ্রমিকরা ধারাবাহিকভাবে বলেছে যে, তাদের নিরাপদে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ বা সরঞ্জাম সরবরাহের দরকার তা কখনোই দেওয়া হয় না। গলিত ইস্পাত কাটার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া এড়াতে শ্রমিকরা তাদের শার্ট মুখের চারপাশে মুড়িয়ে নেয় এবং খালি পায়ে ইস্পাতের টুকরো বহন করার সময় তাদের হাত পোড়ানো এড়াতে গ্লাভস হিসাবে তাদের মোজা ব্যবহার কর। স্বাস্থ্যগত এসব ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য মানুষের চেয়ে এই শিল্পে কাজ করা মানুষের গড় আয়ু ২০ বছর কম বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
জাহাজ-ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের উপর স্থানীয়ভাবে করা ২০১৯ সালের একটি জরিপকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এই শিল্পের কমপক্ষে ১৩ শতাংশ শ্রমিক শিশু। রাতের শিফটে এই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই পর্যবেক্ষণের সাথে পুরোপুরি একমত পোষণ করেছেন শ্রমিক অধিকার কর্মী কল্পনা আক্তার।
ডয়েচে ভেলেকে তিনি বলেন, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষণায় আসলে জাহাজ-ভাঙা শিল্পের সত্যিকারের অবস্থাটাই উঠে এসেছে। এখানে শিশুর কথা যেরকম আছে, শ্রমিকদের অনিরাপদ একটি কর্ম পরিবেশের কথাও বলা হয়েছে। এই জাহাজগুলো টক্সিক ম্যাটেরিয়াল ক্লিন করে আমাদের দেশে ঢোকার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। শ্রমিকরা এতটা অনিরাপদ এবং আতঙ্কিত থাকে যে, যে-কোনো সময়ে যে-কোনো ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এখানে সেফটি ইকুইপমেন্ট দেওয়া হয় না। শ্রমিকরা তাদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে গেলেও অনেক আতঙ্কিত থাকে, কারণ, যারা এই শিল্পের মালিক, তারা সব সময় চেষ্টা করে এই শ্রমিকদের ভয়েসকে দাবিয়ে রাখার, এই শ্রমিকরা যাতে তাদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে না পারে, সে জন্য তাদের নিপীড়নেরও শিকার হতে হয়”, বলেছেন তিনি।
প্রায় একই ধরনের কথা উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিদের বক্তব্যেও। ৩১ বছর বয়সি এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি যেখানে কাজ করি সেখানে যদি এক মুহূর্তের জন্যও বিভ্রান্ত হই, তাহলে আমি তৎক্ষণাৎ মারা যেতে পারি।’
চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে এই শিল্পে কাজ করা ৬২ জন শ্রমিক মারা গেছেন। যার মধ্যে সর্বাধিক ২২ জন মারা গেছেন ২০১৯ সালে। চলতি বছর প্রথম নয় মাসে মারা গেছেন পাঁচজন শ্রমিক। জাহাজ ভাঙা শিল্পের এই পরিবেশ বিপর্যয় এবং প্রাণহানির জন্য পরিবেশ অধিকারকর্মী ও আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান উন্নত বিশ্বের স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গিকেই অনেকটা দায়ী করেছেন।
“জাহাজ ভাঙা শিল্প, যেটাকে আমরা বাংলাদেশে শিল্প বলছি এটা কোনোভাবেই শিল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এটা হচ্ছে উপকূলীয় শ্রমিকদের জীবন ধ্বংসের একটি অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড। এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশেরই যে মুষ্টিমেয় কিছু জাহাজ ভাঙা মালিক সুবিধা ভোগ করেন তা না, এটা উন্নত বিশ্বকেও অনেক সুবিধা দেয়। উন্নত বিশ্ব যে জাহাজগুলো বাংলাদেশে পাঠায়, সে জাহাজগুলো বাংলাদেশে না পাঠিয়ে তাদের দেশে ভাঙতো যেটা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের করার কথা, তাহলে তাদের লাভ খুব কম হতো। তারা এই জাহাজগুলো বেশ মূল্যের বিনিময়ে বাংলেদেশি মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেন, বাংলাদেশি মালিকরা শিল্পের জন্য যে বিনিয়োগ লাগে, অবকাঠামো উন্নয়নে সেই বিনিয়োগ ছাড়াই উন্মুক্ত বিচে আকাশের নিচে জাহাজ ভাঙা কার্যক্রম পরিচালনা করে যেটা উন্নত বিশ্বে কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতো না...আমাদের জীবনের মূল্য তারা খুব কম হিসেবেই দেখে।”
জাহাজ ভাঙা শিল্পের এসব অনিয়মের অভিযোগ সরাসরি উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, “কোনো অভিযোগ নাই...অনিয়ম কিছু নাই, কোনো শিশু শ্রমিক নাই। কিছু নাই এখানে। বাংলাদেশে শিপ ব্রেকিং এখন অনেক উন্নত হয়ে গেছে। ইউরোপিয়ান কোনো শিপ আমাদের এখানে আসে না, খুব রেয়ার।”
সরকারি সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও দাবি করেছে তারা নিয়মিত এসব শিল্পকে পর্যবেক্ষণ করেন। “কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর প্রতি মাসে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ (অগ্রিম পরিদর্শন পরিকল্পনা) অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এস ও পি মোতাবেক নির্দিষ্ট চেকলিস্ট অনুযায়ী পরিদর্শন করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তদন্ত ও মীমাংসা, দুর্ঘটনার তদন্ত, কাজের সময়সূচি অনুমোদন, নতুন লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, লে-আউট অনুমোদন ও সংশোধনে, জরিপ এবং অন্যান্য কারণে বিশেষ পরিদর্শন করা হয়”, বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্র্রাম অঞ্চল প্রধান সাকিব আল মুবাররত।
সাকিব আল মুবাররত আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর প্রযোজ্য ধারা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও সেফটি সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পেশাগত ব্যাধির ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিতকরণ, সেফটি কমিটি গঠন ও কার্যক্রম মনিটরিং, স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্ষালন ও অন্যান্য সুবিধাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
সরকার সম্প্রতি হংকং কনভেনশন অনুমোদন করায় আগামী দুই বছরের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নত হবে বলে আশা করছেন স্থানীয় এনজিওকর্মীরা।
“এই হংকং কনভেনশন কমপ্লাই করতে হবে আগামী দুই বছরের মধ্যে পুরো ইন্ড্রাস্ট্রিতে। এর মানে হচ্ছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে সবগুলো শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ড হতে হবে। এই বিষয়গুলোই আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি,” বলেছেন বেসরকারি সংস্থা ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন-এর প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী আলী শাহীন।