প্রাথমিক শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী দ্যুতি ছড়াচ্ছেন রায়হানা হক
প্রাথমিক শিক্ষায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী দ্যুতি ছড়াচ্ছেন রায়হানা হক। অজপাড়াগাঁয়ের পিছিয়েপড়া একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর শিক্ষার্থীদের পৃথিবীর ৩৫টি উন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছেন তিনি। অর্জন করেছেন দেশ ও বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
রায়হানা হক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের ‘বাঁশগাড়ি-১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ প্রধান শিক্ষক তিনি।
বিদ্যালয়টি উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁয়ের অনুন্নত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানকার অধিবাসীদের বেশিরভাগের পেশা কৃষি কাজ। অল্পসংখ্যক জুতা কারখানার শ্রমিক আর মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। শিক্ষা যাদের কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহণ করে না।
এমন একটি পিছিয়ে পড়া গ্রাম আর সেই গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তিনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিচিতি করে তুলেছেন ইউরোপ-আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার ৩৫টি দেশের সঙ্গে। আর এটি খুব সহজে করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা বিস্তারে অদম্য আলোর দিশারী একজন রায়হানা হকের অকল্পনীয় শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা, সংকল্পবোধ, একাগ্রতায় সেটি সম্ভব হয়েছে।
জানা যায়, দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা রায়হানা হক ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত চারটি স্কুলে তিনি প্রাথমিকের সরকারি কারিকুলামের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রয়োগ ঘটান এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমূল পরিবর্তন আনেন। ফলে চারদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যে সুনাম তাঁকে এই বিভাগের অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দেয়।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল রায়হানা হক যোগদান করেন ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামে অবস্থিত বাঁশগাড়ি-১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ সময় বিদ্যালয়টির সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়া দৃশ্যমান ছিল। আর এর অন্যতম কারণ ছিল পড়াশোনার নিম্নমান, বিদ্যালয় বিমুখতা, অভিভাবকদের অসচেতনতা, অজপাড়াগাঁ হওয়ায় শিক্ষকদের এই বিদ্যালয়ে বেশিদিন না থাকা ইত্যাদি।
রায়হানা হক তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা, পরিকল্পনা দিয়ে বিগত ১০ বছরে বিদ্যালয়টিকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে তিনি এমন এক শক্ত বলয় গড়েছেন, যেন মা-বাবা আর সন্তান নিয়ে একটি সুখী পরিবারের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বর্তমানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে বিদ্যালয়টির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
এখানে রায়হানা শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি মেধা আর মনন চর্চায় সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিয়মিত এসবের চর্চার পাশাপাশি শরীর আর ক্রীড়া চর্চায়ও পারদর্শী করে তুলছেন। নিয়মিত ক্লাস ও স্কুল পর্যায়ে এসবের প্রতিযোগিতার আয়োজন করছেন। যেখানে সেরাদের জন্য রাখছেন পুরস্কারের ব্যবস্থা।
শুধু কি শিক্ষার্থীদের জন্যই আয়োজন? না। অভিভাবকদেরও অংশগ্রহণ থাকছে। সপ্তাহে একদিন একেকটি শ্রেণিতে ‘মায়ের সাথে শিখি’ নামে একটি পর্ব থাকে। যেখানে একজন মা তাঁর নিজ সন্তান ও অন্য শিক্ষার্থীদের রাউন্ডে বসে বইয়ের গল্প/কবিতা/প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করেন বা শুনেন।
অপরদিকে কৃষি, পরিবেশ, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে পড়ানোর সময় রায়হানা হক শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখাতে নিয়ে যান ফসলের জমিতে, মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে। এতে তাঁর শিক্ষার্থীরা বাস্তব শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাটাকে আনন্দ আর বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করে।
শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য রায়হানা হক খেলাধূলার বিভিন্ন সরঞ্জাম রেখেছেন স্কুলটিতে। যা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা বেশ উৎফুল্ল থাকছে বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা, যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলায় উৎসাহিত করতে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের সামনে রেখেছেন ময়লা ফেলার সুন্দর বাস্কেট। জুতা রাখার জন্য রেক। নিজেদের পরিপাটি করার জন্য দেয়াল আয়না আর চিরুনি।
খাতা-কলম, বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট, আচার, চিপস্ ইত্যাদি সহজে কেনার জন্য স্কুল বারান্দায় বসিয়েছেন ‘বিশ্বস্ত স্টোর’। যেখানে সততার সঙ্গে লিখিত মূল্য নিজেরা জমা দিয়ে পণ্যটি গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। দেওয়ালের বিভিন্ন স্থানে জীবন গঠনমূলক বাণী সেঁটে রাখা হয়েছে শিক্ষার জন্য। দেওয়ালে দেওয়ালে আর্ট করা আছে নানা পশু-পাখি, বন-বাঁদাড়ের ছবি।
ছোট পরিসরে বই পড়ার ব্যবস্থা, ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল কর্নার। মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও তাঁদের পরিচিতি, পাখিদের সাথে পরিচিত করে তুলতে স্কুল বারান্দায় আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে। গরীব শিক্ষার্থীদের পোশাকের চাহিদা মেটাতে ‘মহানুভবতার দেওয়াল’ নামে কর্ণারে টানিয়ে রাখা হয়েছে নানা রঙের পোশাক।
আছে ইন্টারনেট সংযোগসহ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। সেখানে রয়েছে এলইডিটিভি, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ মাল্টিমিডিয়াবিষয়ক নানা উপকরণ। এসবের নিরাপত্তায় আছে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও।
এ তো গেল প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। প্রাক-প্রাথমিকের শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আছে দুটি রঙিন সাজানো-গোছানো কক্ষ। যেখানে এত এত খেলনা। একজন করে শিক্ষক সেখানে খেলার পাশাপাশি ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত করে তোলার পাশাপাশি ছড়া-কবিতা, গান শেখান।
স্বতন্ত্র একটি কক্ষে আছে গোছানো ‘শিশুমঞ্চ’। সেখানে শিশুরা উপস্থাপনাসহ আবৃত্তি, গান, বক্তব্য, গল্প বলা ইত্যাদি উপস্থাপন করে থাকে।
এসব শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষকদের জন্য কি কিছু আছে? নিশ্চয় আছে। সেটি হলো-একজন শিক্ষকের উপস্থিতি, ড্রেসআপ, আচরণ, সময়জ্ঞান, নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া, পাঠদানসহ অন্যান্য কাজের সার্বিক মূল্যায়ন করে মাসিক ভিত্তিক একজনকে দেওয়া হয় সেরা শিক্ষকের পুরস্কার।
রায়হানা হক তাঁর সৃষ্টিশীলতা আর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিকবার ‘শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া নানামুখী কাজের জন্য সরকারিসহ বেসরকারি পর্যায়ে দেশি-বিদেশি ও সংস্থা-সংগঠন থেকে অসংখ্য পুরস্কারের ভূষিত হয়েছেন।
রায়হানা হক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে বাংলা একাডেমিতে প্যানেলে থেকে একটি আলোচনায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ই-বুক তৈরির জন্য যোগদান করেন তিনি।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদপত্রে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রায়হানা হক লিখেছেন বিভিন্ন আর্টিকেল। তাঁকে নিয়েও আবার অনেকে লিখছেন। ইতোমধ্যে তিনি জাপান, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন ট্রেনিংসহ সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। বিনিময় ও অর্জন করেছেন অভিজ্ঞতা। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ ওইসব দেশের শিক্ষকরাও তাঁর স্কুলে সফরে এসেছেন।
রায়হানা হক নিয়মিত আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৩৫টি দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কাইপিতে সংযুক্ত থেকে তথ্য আদান-প্রদান করছেন। ভাব বিনিময় করছেন তিনি ও তাঁর শিক্ষার্থীরা। তাঁর শিশু শিক্ষার্থীরা ওইসব দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইংরেজি, তুর্কি, হিন্দি ভাষায় কুশলাদি বিনিময় করছে খুব সহজেই। এ ছাড়া কৃষ্টি-কালচার চর্চার বিনিময়ও হচ্ছে নিয়মিত।
রায়হানা হক ১৯৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শিবপুর সরকার বাড়ির ফজলুল হক সরকার তাঁর বাবা। তিনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন গুণী শিক্ষক ছিলেন। ছোটকাল থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক বাবার ভালোবাসা, যত্ন আর মমত্ববোধ থেকেই রায়হানার, মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নের বীজ বপন হয় বলে জানান তিনি।
রায়হানা হকে এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে ২০২১ সালের গোঁড়ার দিকে দেশের শীর্ষ মোবাইলফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন তাদের নেটওয়ার্কের বিস্তার নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করে। এতে দেশ-বিদেশে তিনি বেশ পরিচিতি লাভ করেন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, “রায়হানা হক প্রাথমিক শিক্ষায় নিজস্ব ভাবনা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, কমিটমেন্ট, একাগ্রতা, গুডলিডারশিপ শুধু উপজেলা, জেলা বা বিভাগ নয়, জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তিনি দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের অন্যতম আইকন।”