হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ড বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত : আদালত
রাজধানীর গুলশানের আলোচিত হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা মামলায় সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর) বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন—জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ।
বাংলায় দেওয়া রায়ে আদালত বলেন, বিচারিক আদালত যে ধারায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, সেই ধারায় আসামিদের অপরাধ হয়নি। সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯ এর ধারা ৬ এর (আ) তে অপরাধ করেছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজাই যাবজ্জীবন। কিন্তু বিচারিক আদালত ভুল করে (অ) উপ-ধারায় সাজা দিয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগ আজকে রায়ে বলেছেন, বিচারিক আদালত ভুল ধারায় সাজা দিয়েছিলেন। এ কারণে উচ্চ আদালত সেই রায়ে হস্তক্ষেপ করে আমৃত্যু সাজা দিয়েছেন।
রায়ে আদালত বলেন, আলোচ্য মামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিকসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে যে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করা করা হয়েছে, তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া বর্ণিত নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। এমতাবস্থায়, ১৮ এডিসি পৃষ্ঠা-৮৯ এ বর্ণিত আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র মামলার নজিরের ১৭৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত পর্যবেক্ষণের মর্মানুসারে আপিলকারীগণকে আমৃত্যু কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
সে মতে, আপিলকারী জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদকে আমৃত্যু কারদণ্ড দেওয়া হলো। একইসঙ্গে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর দণ্ড দেওয়া হলো। রায়ে আদালত বলেছেন, আসামিদের স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাগারেই থাকবেন।
রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিমুল এহসান জুবায়ের বলেন, আদালত রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা ডেথ রেফারেন্স খারিজ করে দিয়েছেন। আর আসামিদের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে মৃত্যুদণ্ড থেকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। বেলা ১১টা ২৭ মিনিটের দিকে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় আপিলের (আপিল ও ডেথ রেফারেন্স) শুনানির রায় পরা শুরু করেন আদালত।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। এ ঘটনার মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান একজনকে খালাস দিয়ে সাত জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেন তখন ওই দণ্ড কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত।
নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। এরপর বেঞ্চ নির্ধারণ হলে শুনানি শুরু হয়। দেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস এ হামলায় নয়জন ইতালীয়, সাত জাপানি, এক ভারতীয়, এক বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশিসহ মোট ২০ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ হারান বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন আহমেদ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম।
হামলার পর জিম্মি অবস্থার অবসানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। তারা হলেন—মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় নিহত হয়েছে নব্য জেএমবির আরও আট সদস্য। তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিমও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
এই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন ওই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।