পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় পদ্মা নদী এখন মরা খাল
গাঙচিল আর ছোঁ মারে না পদ্মার বুকে, গাঙ শালিকও আর ঘর বাঁধে না পদ্মার পাড়ে। এমনকি পরিযায়ী পাখির কিচির-মিচির শব্দও নেই; মাঝি আর পদ্মা নিয়ে গান ধরে না, নদীতে মাছও কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। দিনদিন পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় পদ্মা নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এমনকি পদ্মার সঙ্গে সংযুক্ত ১৮টি শাখা নদী এখন ফসলের মাঠ।
এমন অবস্থায় আজ সোমবার (১ জানুয়ারি) পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি কার্যকরের ২৭তম বার্ষিকী। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ পানি বিশেষজ্ঞ দল ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে গঙ্গার পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেই অনুযায়ী পানি বণ্টন হয়ে থাকে। তবে পানি চুক্তির পর থেকে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মা নদী বেষ্টিত ছয়টি জেলায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষ পরিবেশগত হুমকির মুখে পড়েছে। গতকাল রোববার ভারতীয় জল ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণের জন্য কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা রেস্ট হাউসে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা হলেন- ভারতীয় পানি কমিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অঙ্কিত দুদেজা ও সহকারী পরিচালক মুকেশ কুমার শর্মা। বাংলাদেশের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু পদ্মা নদী বেষ্টিত পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ ও মেহেরপুর জেলার অন্তত তিন কোটি মানুষ ফারাক্কার বাঁধের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে পদ্মার অবস্থা খুবই করুণ। পানি নেই। এমনকি ন্যূনতম পানির প্রবাহ নেই। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারের মধ্যে ১২টি পিলারই শুকনো চরে দাঁড়িয়ে। যে তিনটি পিলার পানিতে রয়েছে তার আশপাশে মানুষ চাষাবাদ করছে। নদীতে মাছ নেই। জেলেরা নৌকা দিয়ে জাল টেনে নিজেদের খাবারের মাছও যোগাড় করতে পারছে না।
অন্যদিকে ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার ১৮টি শাখা নদীসহ উত্তরাঞ্চলের ৫৪টি নদী শুকিয়ে গেছে। শুস্ক মৌসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। সুত্র জানায়, পানি চুক্তির পর থেকে গত ২৭ বছরেও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। এবারও নায্য পানি পাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম। পানির স্তর ১৮০ থেকে সাড়ে ৮৫০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বৃষ্টিপাত কমে গেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে এভাবে চললে ১০ বছর পর এ অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হবে। পাবনার সাঁথিয়া এবং বেড়া অঞ্চলে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে ২৭৫ মিটার বা ৯০০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতাও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।”
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াটার হাইড্রোলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “এবারের প্রবাহ অনেক কম। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল ৯৩ হাজার ৬৪৮ কিউসেক এবং ওয়াটার লেভেল ছিল ৬ দশমিক ৫২ মিটার। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পানির প্রবাহ ও লেভেল হয়েছে যথাক্রম ৮০ হাজার ৫৩৬ কিউসেক এবং ৫ দশমিক ৬১ মিটার।”
রেজাউল করিম আরও জানান, গত বছরের তুলনায় পানির প্রবাহ কমেছে ১৩ হাজার ১১২ কিউসেক এবং ওয়াটার লেভেল কমেছে দশমিক ৯ মিটার। জলবায়ু পবির্তনের কারণে পৃথিবীর নদীগুলোর ভূগর্ভস্থ উচ্চতা বেড়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।