খতনায় কেন শিশু মৃত্যু, যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও
সুন্নতে খতনা বা মুসলমানি একটি সাধারণ অস্ত্রোপচার। গ্রাম-গঞ্জে এখনও সুন্নতে খতনা করেন হাজাম। যিনি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খতনার কাজ সম্পন্ন করেন। এ পদ্ধতিতে কখনো-সখনো খতনা করা শিশু কেঁদে ওঠেন, ব্যথা পান। যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সমর্থন করে না। কারণ, এ পদ্ধতিতে ঝুঁকির কথা বলে থাকেন অধুনিক চিকিৎসকরা। তাই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পদ্ধতিতে অ্যানেসথেশিয়ার (অসাড় বা অজ্ঞান) ব্যবহার করা হয় খতনা করার সময়।
হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে সার্জারির মাধ্যমে শুরু হয় পুরুষাঙ্গের নির্দিষ্ট অংশের অপসারণের কাজ। এজন্য অবশ করতে হয় শরীরের নির্দিষ্ট অংশ বা পুরো শরীর। বিপত্তি হয় তখন, যখন অস্ত্রোপচার করার পর কোনো কোনো শিশুর আর জ্ঞান ফেরে না, ক্ষেত্রবিশেষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। আর এমন ঘটনা ঘটলে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার। তারা বুঝতে পারেন না, তাদের শিশুদের কোথায় ও কীভাবে খতনা করাবেন।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগে জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর। সুন্নতে খতনা করার জন্য তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছিল। ছোট এ অস্ত্রোপচারের জন্য শিশুটিকে পুরো অজ্ঞান করা হয়েছিল বলে স্বজনদের অভিযোগ। ওই ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই ডা. মোক্তাদির হোসেন ও ডা. মাহবুব হোসেন নামে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই সঙ্গে হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
খতনা করাতে গিয়ে একইভাবে গত ৭ জানুয়ারি প্রাণ হারায় পাঁচ বছরের আরেক শিশু। পুরোপুরি অজ্ঞান করে গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এ ঘটনায় পরিবারের করা মামলায় অ্যানেসথেশিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. সাঈদ সাব্বির আহমেদ ও সার্জারি চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবিনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এ দুটো ঘটনার পর উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন অনেক বাবা-মা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হয়। রাজধানীর কাঁঠালবাগানে বসবাস করা নাজমুল হুদা নামের এক বাবা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স ৪ বছর। আমি ভাবছিলাম, দু-এক মাসের মধ্যেই সুন্নতে খতনা করাব। কিন্তু, খতনা করতে গিয়ে পরপর দুটি শিশুর মৃত্যু আমাকে ভাবাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, হাজাম দিয়ে গ্রামে খতনা করাতেন। কখনো তো শুনিনি, কেউ মারা গেছে। অধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে যদি এমন হয়, তাহলে আমরা কার কাছে যাব?’
কিন্তু, কেন এমন হয়? কেন অজ্ঞান করানোর পর আর জ্ঞান ফেরে না রোগীর। এ প্রশ্ন করা হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেশিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম শফিকুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সাধারণত আমরা তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে বাচ্চাদের এ অপারেশনটা করি বা অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে থাকি। সেজন্য, এটা খুব একটা সেনসেটিভ অ্যানেসথেশিয়া। দুই শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে। সেজন্য, কতটুকু চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত হবে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
ডা. এস এম শফিকুল আলম বলেন, ‘সার্জনের জন্য খুব সুবিধা হয়, যদি জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে অপারেশনটা করা হয়। বাচ্চাদের অন্য কোনো অর্গানে যদি সমস্যা থাকে, যেমন, ব্রেনে, হার্টে বা লিভাবে; এদের জ্ঞান ফিরতে একটু দেরি হয়। এ ছাড়া যদি অপারেশনের সময় অক্সিজেন সাপ্লাই বা ওষুধের কারণে সমস্যা হয়, তখন জ্ঞান ফিরতে আরও দেরি হতে পারে। সেজন্য, একটি শিশুর জন্মের পর থেকে খতনা পর্যন্ত সব ধরনের শারীরিক অসুবিধার কথা চিকিৎসককে জানানো উচিত। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। তাতে করে চিকিৎসকের অবস্থান গ্রহণ করতে সুবিধা হয় যে; তিনি লোকাল বা স্থানীয়, রিজিওনাল বা আঞ্চলিক এবং জেনারেল বা সাধারণ অ্যানেসথেশিয়া ব্যবহার করবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সার্জন অধ্যাপক আশরাফুল হক কাজল বলেন, অনেক ক্ষেত্রে শিশুর বাবা-মা বলেন, অ্যানেসথেশিয়া দিয়ে অপারেশন করাবেন না। কারণ অ্যানেসথেশিয়ার কিছু ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু, অ্যানেসথেশিয়া ছাড়া জোর করে কোনো শিশুর যদি খতনা করা হয়, তাহলে সে ভয় পেতে পারে। এই ভয় তার জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। সেজন্য একজন অভিজ্ঞ শিশু সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী, তিনি যেভাবে মনে করেন সেভাবে খতনা করানো উচিত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেসথেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তফা কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘খতনার জন্য চিকিৎসকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। বাবা-মার সচেতন থেকে শিশু সম্পর্কে সব তথ্য চিকিৎসককে জানাতে হবে। আবার চিকিৎসকেরও উচিত বাবা-মার সব কথা ভালোভাবে শুনে প্রয়োজনে শিশুর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুন্নতে খতনা করা উচিত।’
সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার সোনাবাড়ীয়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। যিনি এলাকায় হক সাহেব নামে পরিচিত। তার বাবা রফিকুল ইসলাম ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পহেলা ফাল্গুন ১১০ বছর বয়সে মারা যান। হক সাহেবও প্রায় ৪০ বছর ধরে একই কাজ করছেন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, আজকে ৬টা খতনা করাইছি। আগামীকাল শুক্রবার, ১০ থেকে ১৫টা করাব। গড়ে বছরে কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৫০০ শিশুর খতনা করাই। আমার হাতে গত ৪০ বছরে খতনা করেছে এমন কারও কখনো ক্ষতি হয়নি। আমার দাদাও হাজাম ছিলেন। তার বাবাও হাজাম ছিলেন। আমাদের চোদ্দগোষ্ঠী হাজাম ছিলেন। কারও কাছে কখনো শুনিনি, কোনো শিশু খতনা করতে গিয়ে মারা গেছে। আর হাসপাতালে নিয়ে ওটিতে ঢুকিয়ে অজ্ঞান-ফজ্ঞান করিয়ে শিশুদের যখন খতনা করানো হয়, তখন সে ভয়েই অর্ধেক মরে যায়। আবার পরিবারের কাউকেও সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আর আমরা প্রকাশ্যে সবার সামনে আদর-আহ্লাদ করে খতনা করাই।
হক সাহেব আরও বলেন, ‘আগে এক সময় কোনো মেডিসিন ব্যবহার করতাম না। এখন অবশ করা ইনজেকশন দিই পুরুষাঙ্গের চামড়ায়। একটু লেবানন পাউডার দিই। কিছু ওষুধ দিই। কারও ঘা সাতদিনে সেরে যায়, কারও ১০ দিন। ১০ দিনের বেশি ঘা শুকাতে কারই সময় লাগে না। আমার পারিশ্রমিক হিসেবে এক হাজারের কম দেয় না কেউ। ওপরে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আর যারা গরিব, তাদের একেবারে কমেও কাজ সেরে দিই। কারও কারও ফ্রিও করে দেই।’
সোনাবাড়ীয়া গ্রামের বাসিন্দা সুজন মিয়া। তিনি ১০ ফেব্রুয়ারি তার ছোট ছেলে শাহিনের সুন্নতে খতনা করেছেন হক সাহেবের কাছে। সুজন মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে একেবারেই সুস্থ হয়ে গেছে। সে এখন হাঁটাচলা করতে পারে ভালোভাবেই।’
চিকিৎসকরা জানান, স্থানীয় ও আঞ্চলিক অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা হয় শরীরের বিশেষ একটি অংশ অবশ করতে, যখন রোগী অপারেশন চলাকালে জেগে থাকেন। যেখানে, জেনারেল বা সাধারণ অ্যানেসথেশিয়া রোগীকে অপারেশন চলাকালে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। অ্যানেসথেশিয়ার ব্যবহারের জন্য কোনো ব্যক্তি অপারেশনের সময় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান। অ্যানেসথেশিয়া বিভিন্ন রকমের ওষুধ ব্যবহার করে করা হয়; যাকে অ্যানেসথেটিক ড্রাগ বলা হয়। বৃহত্তর অর্থে, অ্যানেসথেটিক ড্রাগ বা অনুভূতিনাশক ওষুধ সাধারণত তিন প্রকারের হয়।
গত ৭ জানুয়ারি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে হাইকোর্টে জমা দেয়। যদিও আয়ানের মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট করে বলা হয়নি সেখানে।
প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, অপারেশনের আগে আয়ানকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হলেও চিকিৎসকদের তা জানানো হয়নি। আর অপারেশনের সময় আয়ানের ‘স্বাভাবিক রক্তপাত’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
শিশুটির এমন মৃত্যুর জন্য সরাসরি কাউকে দায়ীও করা হয়নি প্রতিবেদনে। ভবিষ্যতে এ ধরনের মৃত্যু এড়াতে চার দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে উপ-পরিচালক (আইন) পরিমল কুমার পাল রোববার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর বেঞ্চে প্রতিবেদনটি জমা দেন।