পদ্মার বুকে চিকচিকে বালি, হেঁটেই পাড়ি!
এক সময়ের উত্তাল পদ্মা নদীর বুকে এখন শুধুই চিকচিকে বালি। মাইলের পর মাইল শুধু বালি আর বালি। সেই কাকডাকা ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নানা পেশার মানুষ পদ্মার বালুচর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাড় হয়ে পাবনা ও কুষ্টিয়া শহরে যাতায়াত করে।
পদ্মার বুকে সামান্য যেটুকু পানি আছে তার কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পানি। যে পদ্মায় ছিল উত্তাল ঢেউ, সেই পদ্মা এখন পানি শূন্য হয়ে খাঁ খাঁ করছে। দেখে মনে হয় না যে এক সময় এখানে পদ্মার ঢেউ ছিল। ছিল পানির উত্তাল তরঙ্গ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রাজশাহী জেলার চারঘাট থেকে শুরু করে পাবনার শেষ সীমানা মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সংযোগস্থলে মিশে গেছে এই পদ্মা। পদ্মায় এখন পানি না থাকায় দুই পারের মানুষ এখন হেঁটে হেঁটেই পার হচ্ছে। মাঝ নদীতে সামান্য পানির ধারা থাকলেও তা অনেক স্থানেই হেঁটে বা আধা সাঁতরিয়ে পার হওয়া যায়।
পদ্মার বুকে ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মিত হয়। সেতু পারাপারের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার করেছিল রেল সেতু। প্রায় ৮৮ বছর পর রেল সেতুর ৩০০ মিটার ভাটিতে ২০০৩ সালে নির্মিত হয়েছে লালন শাহ সেতু। দুই সেতুই এখন ধুধু বালুচরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। যে কেউ দেখলে ভাবতেই পারবে না এই সেতু দুটি নদীর উপর নির্মিত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ সেতু পাড় থেকে পাবনার বেড়া উপজেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত নদী পারাপারের জন্য ১০টি স্থানে খেয়া নৌকার ঘাট রয়েছে। ওই সব ঘাট দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই পাড়ের ৫০ হাজার মানুষ পারাপার হয়ে থাকে। তবে দুপুরে চরের বালু রোদে প্রচন্ড গরম হওয়ায় এ সময় নদী পারাপার কমে যায়। এ যেন এক মরুভূমি।
পাবনা সদর উপজেলার কোমরপুর খেয়াঘাট এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ২৫ বছর আগে যে পদ্মা দেখেছেন এখন তা খাল হয়ে গেছে। এই নদীর পানির গর্জন পাঁচ কিলোমিটার দুরে পাবনা শহর থেকেও শোনা যেত। কিন্তু এখন সেখানে বালুচর আর কাশবন। পানির বদলে এখন সেখানে গরম বালি।
পাবনা ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহ নদী পারাপারের জন্য এখানে রয়েছে খেয়াঘাট। এ ঘাট দিয়ে প্রতি দিন কমপক্ষে ১০ হাজার লোক পারাপার হয়। এই ঘাট দিয়ে পাবনা থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ পারাপার হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী দেখতে যায়। পদ্মা নদীর এই খেয়াঘাট দিয়েই সবচেয়ে বেশি মানুষ পার হয়ে থাকে। নানা পেশার মানুষের মধ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার দয়রামপুর গ্রামের দুজন দুধের ছানা বিক্রেতা মৃত্যুঞ্জয় ও জিলাল টিনে করে ছানা প্রতিদিন নিয়ে আসে পাবনার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে। বাইসাইকেলে নিয়ে আসা টিন ভর্তি দুধের ছানা নিয়ে বালুচরে আটকে যায়। সে এক করুণ দৃশ্য। মৃত্যুঞ্জয় জানান, এটাই তাদের নিত্য দিনের চিত্র।
সুত্র জানায়, পদ্মার বুকে আজ থেকে প্রায় ৪ দশক আগে আটটি মৌজা নিয়ে জেগে উঠে একটি বিশালাকৃতির বালুচর। মৌজাগুলো হলো পাবনা সদর উপজেলার চরভবানিপুর, খাসচর ধোকরাকোল, খাসচর বলরামপুর, পীরপুর, আড়িয়াগোহাইলবাড়ী, রাণীনগর, চরমাছপাড়া ও গঙ্গাধরদিয়া। পদ্মার বুকে এটাই সবচেয়ে বড় জনবসতির চর। প্রায় ১২ কিলোমিটার লম্বা এবং স্থান ভেদে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত এই বালুচরে এখন প্রায় ৩০ হাজার লোকের বাস। এখানে নেই কোনো রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল, এমনকি শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত নেই। নেই কোনো হাটবাজার, বিদ্যুতের আলো। এখানকার মানুষ প্রতিদিন এই ধুধু বালুচর পেরিয়ে ওপারে কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খোকসা উপজেলার আমবাড়ীয়া, আমলাবাড়ী, গোপগ্রাম, হাসিমপুর এবং নদীর উত্তরপাড়ে পাবনার সুজানগর, হাজিরহাট, বলরামপুর, দোগাছীর সাপ্তাহিক হাটবারে এসে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করে নিয়ে যায়। এই চরাঞ্চলের মানুষ যেন নিজের এলাকায় বাস করেও পরবাসীর মতো জীবন যাপন করছে। এই হলো পদ্মা নদীর বর্তমান বাস্তব চিত্র।
এই চরের মানুষের বেশিরভাগই দিনমজুর। তবে চরের অনেক এলাকায় এখন চিনাবাদাম, পটল, করলা, তিল, মাসকালাই আবার কোনো কোনো স্থানে ধান আবাদ হচ্ছে। তবুও বছরে একবার। বর্ষা এলেই বালুচর ডুবে পানিতে থৈ থৈ করে। বাড়ির চার পাশে থাকে শুধু পানি আর পানি। তখন নৌকা ছাড়া তাদের যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম থাকে না। মানুষের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রায় প্রতি মাসেই দু-একজন মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
আকস্মিক কোনো রোগে আক্রান্ত হলে কোনো রোগীকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নদীর দুই পারে পাবনা ও কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। রোগী বহনের একমাত্র বাহন বাঁশের ঝাঁকা। এ যেন আদিম যুগের এক বাহন। গর্ভবতী প্রসুতি মা কখনও নিয়মিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষার সুযোগ পান না। ফলে সন্তান প্রসবকালে জেলা ও উপজেলা সদরের হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে অনেকেই অকালে মারা যান। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে এই হলো পাবনার পদ্মা নদীর চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের জীবন সংগ্রাম। আর তারা চায় যেভাবেই হোক পদ্মা যেন আবার প্রবহমান হয়। যেন মরুতে পরিণত হতে না হয় এই এলাকার দুই কোটি মানুষকে।