‘রোদে ডিউটি করতে করতে চামড়া গন্ডারের মতো হয়ে গেছে’
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা পেরিয়ে বিজয় সরণির মোড়। দুপুর গড়িয়ে বেলা ৩টা হলেও রোদের তীব্রতায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের দুজন সদস্য সড়ক শৃঙ্খলায় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
পুলিশ কনস্টেবল আব্বাছ (৫২) তাঁদের একজন। ৩২ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগে কর্মরত তিনি। প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যেও আব্বাছ ছাতা মাথায় দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আব্বাছের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ তপ্ত রোদে একটু দাঁড়ানোই সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দায়িত্ব পালন করতে সমস্যা হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘রোদে ডিউটি করতে করতে চামড়া গন্ডারের মতো হয়ে গেছে। এখন আর অসুবিধা হয় না। আর দায়িত্ব পালন করতে গেলে কষ্ট একটু করতেই হবে।’
এ কথা বলে আব্বাছ রাস্তার অবস্থা বুঝতে সামনে তাকালেন। দেখলেন, বয়স্ক ব্যক্তি একটি পানির বোতল তাঁর দিকে এগিয়ে ধরে বলছেন, ‘গাড়ি থেকে একজন আপনাকে পানিটা দিতে বললেন। ধরেন, পানি খান।’
এ কথা শুনে আব্বাছ বলে ওঠেন, ‘কিছু মানুষ আছেন, যারা ভালো। অনেকেই এভাবে পানি পাঠিয়ে দেন। কেউ কেউ শরবতও খাওয়ান। আমরা মানুষের জন্য সড়কে শৃঙ্খল রাখি, মানুষ ভালোবেসেই এই গরমে পানি-শরবত খাওয়ান।’
বিজয় সরণির পথ পেরিয়ে জাহাঙ্গীর গেটের মোড়ে ছাতার নিচে একজন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি নাম প্রকাশ না করার কথা জানিয়ে বলেন, ‘গতকালে আজকে গরম কিছুটা কম। তারপরও গরমে কষ্ট হচ্ছে দাঁড়াতে।’
জাহাঙ্গীর গেট পেরিয়ে মহাখালীর হয়ে অভিজাত এলাকা বনানী পৌঁছানোর পর দেখা গেল, ২৭ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করা কনস্টেবল জুয়েল রাস্তার মোড়ে একাই একটি প্লাস্টিকের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। অবস্থান জানতে চাইলে বলেন, ‘আজ একটু গরম কম লাগছে। তারপরও স্যারেরা পানি দেন, স্যালাইন দেন। আজ পহেলা মে শ্রমিক দিবস হওয়ায় সরকারি ছুটি। রাস্তায় একেবারেই মানুষ কম। সিগন্যালে সমস্যা হচ্ছে না। টুকটাক হাত নাড়লেই সব ঠিকঠাক চলছে।’
বনানীর ট্রাফিক বুথের মধ্যে বসেছিলেন কনস্টেবল ফাইজুল। তিনি বলেন, ‘আজ একটু আরাম লাগছে। জ্যাম নেই। সেজন্য শুধু একজনই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। জ্যাম থাকলে অন্তত চারজন দাঁড়িয়ে থাকা লাগত।’
বনানীতে ট্রাফিক সার্জেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন মো. বাদশাহ। তিনি বলেন, ‘গরমের কথা চিন্তা করে ডিএমপি থেকে পানি-শরবতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দায়িত্ব পালন করা ছাড়া তো আমাদের আর বিকল্প নেই। তারপরও আমরা সতর্ক থাকি।’
বনানী হয়ে গাড়ি চলতে থাকে জিয়া কলোনির দিকে। বনানী পার হয়ে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গাড়ি চলতে থাকে। এভাবে ইসিবি চত্বর ঘুরে মিরপুর-১২ হয়ে মিরপুর-১১-এর মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে মিরপুর ১০ পর্যন্ত গিয়ে সড়কে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায়নি। সড়কে মানুষ যেমন কম ছিল, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যও কম ছিল। তবে, বুথের মধ্যে ছিলেন দায়িত্বরত সবাই।
মিরপুর এলাকার এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথমত সরকারি ছুটি, দ্বিতীয়ত গরম। সেজন্য, আজ সড়কে লোক অনেক কম। আমাদেরও সুবিধা হয়েছে। সিগন্যালে দাঁড়ানো লাগছে কম।’
সড়ক মোটামুটি ফাঁকাই বলা চলে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে যে পথ ধরে গাড়ি চলে মিরপুর-১০ পর্যন্ত গেল, এর ভেতরে কোথাও একটি সিগন্যালেও পড়তে হয়নি। এভাবে আগারগাঁও হয়ে শিশুমেলার পাশ দিয়ে আসাদগেটের আড়ং পর্যন্তও কোনো সিগন্যালের দেখা মেলেনি।
আড়ংয়ের সামনের ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা যায়, বিনামূল্যে বিশুদ্ধ ঠান্ডা পানি ও শরবত বিতরণ করা হচ্ছে। রোটার্যাক্ট ক্লাব অব ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও রোটারি ক্লাব অব ঢাকা মিডটাউনের উদ্যোগে এ পানি ও শরবত বিতরণ করা হচ্ছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, এ দুটি ক্লাবের বেশকিছু সদস্য সেখানে উপস্থিত থেকে পানি ও শরবত বিতরণ করছিলেন। তাদের সহযোগিতা করছিল কিছু শিশু। তারা অলটাইমের প্লাস্টিকের গ্লাসে করে পাবলিক বাসের মধ্যে ঢুকেও পানি-শরবত বিতরণ করছিল। বাস, সিএসজি ও মোটরসাইকেলের যাত্রীরাও এ পানি-শরবত সাদরে গ্রহণ করছিলেন।
ঘটনাস্থলে থাকা রোটার্যাক্ট ক্লাব অব ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ার শাওন বলছিলেন, ‘আমরা সাতদিনের চিন্তা মাথায় রেখে এ পানি-শরবত বিতরণ করছি। আজ দিয়ে তিনদিন আমরা পানি-শরবত বিতরণ করছি। আরও চারদিন একইভাবে বিতরণ করার ইচ্ছে আছে।’
এভাবে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে আবার ফার্মগেট হয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতেও কোনো সিগন্যালেও গাড়ি দাঁড়াতে হয়নি।