মাটিকাটা শ্রমিক সাইফুর জিপিএ ৫ পেয়েছে
সাইফুর রহমানের বয়স যখন ছয় মাস তখন তার বাবা পরিবার ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। এর তিন-চার বছর পর মায়েরও অন্য জায়গায় বিয়ে হয়। তখন থেকেই দুঃখের জীবন শুরু তার। তাকে নিজের কাছে রেখে কোলেপিঠে করে অনেক কষ্টে মানুষ করেন নানি আফতেরা বেগম (৭০)।
সেই ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার খরচ জোগাতে ট্রলিতে মাটি ভরে দেওয়ার কাজ করত সাইফুর। যখন নিজের কষ্টের কথাগুলো বলছিল তখন তার চোখ ছলছল করছিল। চোখ ভিজে উঠছিল, মাঝেমধ্যে কথার খেই হারিয়ে ফেলছিল।
নানি আফতেরা বেগম বলেন, ‘বাপ-মাছাড়া শিশু সাইফুরকে নিয়ে অথৈ দরিয়ায় পড়ে যাই। প্রথম প্রথম কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি, তার পরও নাতিকে মানুষ করতে চেষ্টা করেছি। মা-বাবার আদর ছাড়া বাচ্চা মানুষ করা কঠিন। কিন্তু সাইফুরের নিজের চেষ্টা ছিল, তাই আজকে সে এত ভালো করেছে।’
আফতেরা বেগম জানান, তাঁরও নিজের কেউ নেই, কিছু জমি বাগি দিয়ে যা ধান পান কোনোমতে চলে আর বাড়ির আঙিনায় পাট শাক, লাল শাক, সবজি চাষ করে বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেন। সাইফুরও নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে মাটিকাটার কাজ করত।
সাইফুর রহমান এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার চরমহল্লা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে। এ জন্য তার স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতা ও উৎসাহ রয়েছে। গ্রামের এই স্কুল থেকে এবার তিনজন জিপিএ ৫ পেয়েছে। এর মধ্যে একজন সাইফুর রহমান।
সাইফুর জানায়, ছোটবেলা থেকেই মামাবাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা সাদকপুর গ্রামে থাকে সে। নান আফতেরা বেগম তাকে ছায়া দিয়ে বড় করেছেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না। নানিই তাকে পড়াশোনায় বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই গাড়িতে মাটি ভরে দেওয়া কাজ করছেন। এতে যা পান তা দিয়ে লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর চেষ্টা করেন।
এখন ভালো ফল করায় জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হতে চায় সাইফুর। কিন্তু এখানে কোথায় থাকবে, কীভাবে লেখাপড়া চলবে—এ নিয়ে শুরু হয়েছে চিন্তা। ভর্তি, বইপত্র কেনার অর্থ কোথা থেকে আসবে—এ নিয়ে নানি-নাতির দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তবে তার ইচ্ছে যে করেই হোক, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া।
জীবনে কি হতে চায় এই প্রশ্নে সাইফুরের কোনো জবাব ছিল না। সে বলে, ‘আমি শুধু ভালো করে লেখাপড়া করতে চাই। পড়া-লেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই।’
চরমহল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘সাইফুর নবম শ্রেণিতে থাকতে ক্লাসে অমনোযোগী ছিল। আমি পরে তাকে পড়ানো শুরু করি। একপর্যায়ে দেখি সে অন্যদের চেয়ে যেকোনো বিষয় সহজেই বুঝে যায়। এত ভালো ফল করবে ভাবিনি। আর্থিক কারণে যেন তার পড়ালেখাটা থেমে না যায়। সহযোগিতা পেলে সে আরও ভালো করবে।’