ঘূর্ণিঝড়ে রিমালে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় রিমাল দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে তাণ্ডব চালাচ্ছে গতকাল রোববার (২৬ মে) থেকে। এতে জানমালের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। অনেক অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। রিমাল তাণ্ডবে এখন পর্যন্ত দেশের বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
আজ সোমবার (২৭ মে) বিকেল পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘর-বাড়ি, গবাদি পশু, মাছ, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাট থেকে এনটিভির নিজস্ব প্রতিবেদক রবিউল ইসলাম জানান, জেলার রামপাল, চিতলমারী, সদর ও মোড়েলগঞ্জের বিস্তৃর্ণ এলাকার চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। গতকাল রাত ১১টা থেকে গোটা এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। জেলার ৭৫ ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চলের কাঁচা ও আধাপাকা ৩৫ হাজার ঘর-বাড়ি আংশিক ও ১০ হাজার ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে সড়ক, বিদ্যুতের পোল ও বসত ঘরের ক্ষতি হয়েছে।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান আল বেরুনী জানান, বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর ও মোড়েলগঞ্জে বেড়িবাঁধসহ ছয়টি স্থানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেলুর রহমান জানান, জেলায় প্রাথমিকভাবে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
খুলনা থেকে এনটিভির নিজস্ব প্রতিবেদক মুহাম্মদ আবু তৈয়ব জানান, খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমেলের আঘাতে ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ ও ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। খুলনার ৭০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার দুর্গত এলাকায় এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান পেয়েছি তাতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ২০০ জন। আর ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৬ হাজার ৯০৪টি এবং মৎস্য সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
চাঁদপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে চাঁদপুরে বাতাসের গতি ও বৃষ্টি বেড়েছে ভোর থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। টানা বৃষ্টিপাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নিচু এলাকায় পানি জমে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
বিআইডব্লিউটিসি চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাটের ম্যানেজার (বাণিজ্য) ফয়সাল চৌধুরী জানান, রোববার (২৬ মে) বিকেল থেকে চাঁদপুর-শরীয়তপুর রূটের ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ভোলা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আফজাল হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ভোলায় আহত হয়েছে আরও অন্তত ২০ জন। দুদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে পুরো জেলা। বন্ধ রয়েছে মোবাইলফোনের নেটওয়ার্কও। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, চর নিজাম, কুকরী-মুকরী, লালমোহনের চরকচুয়া, তজুমদ্দিনের চর মোজাম্মেল, চর জহিরুদ্দিন, সোনার চর, দৌলতখানের মেদুয়া, মদনপুর, সদরের মাঝের চর, চর চটকিমারাসহ অন্তত জেলার অর্ধশত চরাঞ্চল।
ভোলা জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় ৭৪৩টি সাইক্লোন শেল্টার এবং প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রয়েছে। আমাদের প্রস্তুতি ভালো ছিল। নিহত ও ক্ষয়-ক্ষতি যাদের হয়েছে তাদের সাহায্য করা হবে।’
শেরপুরে থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক কাকন রেজা জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব পড়েছে শেরপুরেও। গতকাল রাত থেকেই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। মধ্যরাত থেকেই বিদ্যুৎ যাওয়া আসার মধ্যে রয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন ছিল জেলা শহর। বৃষ্টি ও বাতাসে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে জীবনযাত্রা।
এ ছাড়া রিমালের তাণ্ডবে সারা দেশে এখন পর্যন্ত দেশের পাঁচ জেলায় ৯ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার (২৬ মে) থেকে আজ সোমবার (২৭ মে) দুপুর ১২টা পর্যন্ত বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সাতক্ষীরায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
সাতক্ষীরায় বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম শওকত মোড়ল (৬৫)। তিনি শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের মৃত নরীম মোড়লের ছেলে। ভোলায় ঘরচাপা পড়ে মনেজা খাতুন (৫০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি ভোলার লালমোহনের পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চরউমেদ গ্রামের তেলী বাড়ির আব্দুল কাদেরের স্ত্রী। এছাড়াও ভোলায় আরও দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। চট্টগ্রামের বায়েজিদ চন্দ্রনগর বাজারের পাশে নির্মাণাধীন ভবনের দেওয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে অতিরিক্ত স্রোতে তলিয়ে মো. শরীফ (২৭) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দুপুরে উপজেলার ধুলাস্বার ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত শরীফ অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে। এ ছাড়া রিমালের তাণ্ডবে বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় লিলি পেট্রোল পাম্পের পাশে দেওয়াল ধসে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন ওই এলাকার লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান ও কর্মী মোকসেদুর রহমান। এ ছাড়াও জেলায় আরও একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।