শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে উত্তাল দেশ, শেষ দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি ছাত্রলীগের
ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কারপন্থিদের ওপর গতকাল সোমবার থেকে চলে হামলা। এতে আহত হন কয়েকশ শিক্ষার্থী। অভিযোগের তীর ছিল ছাত্রলীগের দিকে। যদিও তা অস্বীকার করে দলটি। তবে, যতই হামলা চলুক, কোটা সংস্কারের দাবি না মানা পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। সেই ঘোষণার প্রেক্ষিতে আজ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধ করেন মহাসড়ক। সেই প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে হামলা, পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটে হতাহতের ঘটনা। আর ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, সীমা লঙ্ঘন করলে ছাত্রলীগ শেষ দেখে ছাড়বে।
সারা দেশ থেকে এনটিভির প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে থাকছে এবারের প্রতিবেদন।
এ কে এম মঈনুল হক, রংপুর
ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ এবং পুলিশের হামলা ও নেতাকর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে সকাল ১১ টা থেকে রংপুর নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আসে। দুপুর ১টার দিকে প্রেসক্লাব থেকে আন্দোলনকারীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সামনে গেলে পুলিশ, ছাত্রলীগ ওযুবলীগকর্মীরা লাঠিচার্জ এবং আক্রমণ করে। আন্দোলনকারীরাও পাল্টা আক্রমণ করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের শেল ও গুলি বর্ষণ করে। দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও আবু সাইদের মৃত্যুর খবর শুনে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বেরোবি এলাকায় ছুটে এসে সম্মিলিতভাবে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ওপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় টিকতে না পেরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে যায় আর ছাত্রলীগ ও যুবলীগনেতাকর্মীরা বেরোবি ক্যাম্পাসের ভিতরে আশ্রয় নেয়।
দীর্ঘ সাত ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাত ৮টার পর আগামীকাল বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করে ফিরে গেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এর আগে দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকাগুলো রণক্ষেত্র এবং অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু সাইদ নিহত হন। এ সময় ছয় সংবাদকর্মীসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
অন্যদিকে বিজিবি ও র্যাব আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যায়। নিহত আবু সাইদের মরদেহ নিয়ে নগরীতে মিছিল করার সময় পুলিশ মরদেহ আটক করে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়।
তবে নগরীজুড়ে উত্তেজনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। নগরীতে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
মাহবুব হোসেন সারমাত, গোপালগঞ্জ
ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের জয় বাংলা চত্বরে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। পরে তারা লাঠিসোটা নিয়ে ক্যাম্পাসে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ফটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।
বিকেল ৫টার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ হলে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।
হারুনুর রশিদ চৌধুরী, হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ ছাত্ররা। এ সময় তাদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগকর্মীরা। এতে চারজন ছাত্র আহত হন।
শায়েস্তাগঞ্জ থানা পুলিশ জানায়, বিকেল ৩ টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জের নতুন ব্রিজ এলাকা অবরোধ করে সাধারণ ছাত্ররা। এ সময় তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করে। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করে রাখায় দুই দিকে কয়েক শতাধিক যানবাহন আটকা পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগের শিকার হয় যাত্রীরা।
এদিকে, লাঠিসোটা নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় ছাত্রলীগ। এ সময় চার সাধারণ ছাত্র আহত হন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের নেতারা বিক্ষোভ করেন।
আসাদুর রহমান জয়. নওগাঁ
নওগাঁ সরকারি মেডিকেল কলেজে মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা। এ সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে চার শিক্ষার্থী। আজ দুপুরের দিকে নওগাঁ মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের সামনে মানববন্ধনে এ ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানায়, মানববন্ধন শুরুর কিছুক্ষণ পর নওগাঁ সরকারি কলেজে শাখা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এতে চার শিক্ষার্থী আহত হন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে মেডিকেল কলেজের ফটকের সামনে বেলা ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন করছিল। হঠাৎ দুপুরের দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে হামলা চালায়।
এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। হামলার বিষয়ে নওগাঁ সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শরীফুল ইসলাম, চাঁদপুর
সারা দেশের ন্যায় চাঁদপুরেও বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে শিক্ষার্থীরা। আজ দুপুরে চাঁদপুর শহরের অঙ্গীকারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে বাস স্ট্যান্ড এলাকায় গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিলে বাধা দেয়।
এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। দুই পাশ থেকে নিক্ষেপ করা হয় ইটপাটকেল। এতে আহত হয় অন্তত ১০ জন। শহরে কয়েক ঘণ্টা তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের মারধর করে। তাদের দাবি হামলায় অন্তত ১০ থেকে ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসির আরাফাত সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এরপর বিকেলে দুই দফা পাল্টা বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগ। প্রথমেই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জহির উদ্দিন মিজির নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। মিছিল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়।
চাঁদপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বলেন, পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। কোনো শিক্ষার্থী আহত হয়েছে আমাদের কাছে এমন খবর নেই।
আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান
বান্দরবানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তারা শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিলের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়। তাদের বাধা দিতে মাঠে নামে বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরা। পরে বান্দরবান জেলা পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী পায়েল বলেন, আমরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান করছি না। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ যদি চায় নিরস্ত্র সমাবেশ করতে পারেন। গতকাল ঢাকায় নিরস্ত্র অবস্থায় আমাদের সহপাঠীরা অবস্থান করছিলেন। তাঁদের উপর হামলা করা হয়েছে তাতে কোটা আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও রক্তাক্ত হয়েছেন। তাই সরকারের কাছে এই বর্বরোচিত হামলাকারীদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
অন্যদিকে বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পুলু মারমা বলেন, ‘সারা দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষের একটি চক্র কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তাকে পুঁজি করে যাথে কেউ সুবিধা নিতে না পারে সে জন্য একটি কর্মসূচি আগে থেকে নেওয়া ছিল। এ ছাড়া স্বাধীনতার বিপক্ষে ও দেশবিরোধী যেকোনো কার্যক্রমে ছাত্রলীগের সদস্যরা প্রতিরোধ করবে।’