জামায়াতকে নিষিদ্ধের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ বিএনপির
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আজ বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিতে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে গিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ করেছে, তা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল। এই হত্যাযজ্ঞ তথা গণহত্যার দায় থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে গণবিরোধী সরকার তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে কতকগুলো প্রতিষ্ঠানে ন্যক্কারজনক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে উল্টো এসবের দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর ষড়যন্ত্র করছে। অথচ বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত সত্য যে, এই গণহত্যা, ধ্বংস, নৈরাজ্যের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারই দায়ী। জনসাধারণ নিজের চোখে দেখেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্র লীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে নির্মম, নির্দয়ভাবে নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণকে হত্যা করেছে। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আকাশ পথেও হেলিকপ্টার থেকে গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থী, জনতা, বাসা বাড়িতে থাকা নিষ্পাপ ছোট্ট শিশু, গৃহিণী নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-নেতারা তাদের অপরাধ আড়াল করতে এসব ঘটনার জন্য তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’ আবিষ্কার করার অপচেষ্টা করছে এবং ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে বিএনপিসহ অপরাপর বিরোধী দলকে চিহ্নিত করতে বিরামবিহীন অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এসব করে তারা আরও ভুল করছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কোনো ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। তাদের নির্দেশে, পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে। সরকার এর দায় বিএনসিহ অন্যান্য বিরোধী ওপর চাপানোর হীনউদ্দেশ্যে দলের সিনিয়র নেতা এবং কর্মীসহ ১১ হাজার নিরপরাধ ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে, অনেক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন, রিমান্ডের নামে ও কারাগারেও তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গণহত্যা, নৃশংসতা, ফাসিবাদী কায়দায় নির্মম-নির্দয় দমন নিপীড়নের জন্য সরকার দেশ-বিদেশে যখন তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা, চাপের মুখোমুখি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম যখন সরকারকে জবাবদিহি করতে বলছে, দেশে দল মত নির্বিশেষে ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, যুবক, নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ প্রতিবাদ, ধিক্কার জানিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এই ফ্যাসিষ্ট সরকারের পদত্যাগের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন ও চাপে রাখতে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তদন্ত ছাড়াই নিজেদের দায় দায়িত্ব বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিন্দনীয়, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক। ছাত্র আন্দোলনে বর্বরোচিত গণহত্যার দায়ে আওয়ামী সরকারের পদত্যাগের চলমান ইস্যুকে ধামাচাপা দিতে নতুন বিতর্ক, নতুন ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে, যা বুমেরাং হতে বাধ্য। পরিকল্পিতভাবে নন ইস্যুকে ইস্যু বানানোর পুরাতন কার্ড নতুন করে খেলে আওয়ামী লীগ জনদৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারবে না। শত শত ছাত্র, কিশোর, যুবক, শিশুসহ জনতার রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না।
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, এসব হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেরা পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি আরো জটিল ও সংঘাতময় করে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর আশঙ্কা করছে দেশবাসী। অতীতেও তারা নিজেরা সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে। চলমান আন্দোলনেও করছে। বিরোধী দল, মতকে নির্মূল করে বিরোধী দল শূন্য করার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রঘাতি আওয়ামী লীগ তা ভবিষ্যতেও করতে পারে। এজন্য দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলসহ সকলকে সচেতন থাকার আহ্বান জানাই।
“৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম আওয়ামী আমলে বহু বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও রাজনীতি উন্মুক্ত করে একদলীয় বাকশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার অন্যতম আকাঙ্খা জনগণের গণতন্ত্রের লক্ষ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জন-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উন্মুক্ত করা বহুদলীয় রাজনীতির হাত ধরেই বাকশালে বিলীন করা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল বর্তমানে রাজনীতি করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’শহীদ জিয়ার এই উক্তিকে ধারণ করে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ নয়, উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলায় বিশ্বাসী।”
“আজকে যাদের নিষিদ্ধ করতে চায়, সেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাথে আওয়ামী লীগের সখ্যতাও সর্বজনবিদিত। এক সময় তারা পরস্পরের সঙ্গী ছিলেন। ৮০র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী সর্বদলীয় গণআন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সে সময়েও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতারা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে তার পৈতৃক নিবাসে সাক্ষাৎ করে কোরআন ও জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন। উপহার দেয়া-নেওয়ার সময় উভয় দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আজও অনেকের মানসপটে রয়েছে। ৯০ পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে একত্রে সংসদের ভেতর-বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ করেছিল, সংসদ থেকে একত্রে পদত্যাগ করে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সেসময়ে শেখ হাসিনা জামায়াতের নেতাদেরকে পাশে বসিয়ে একত্রে কর্মসূচি দেওয়ার ছবি আজও মানুষের দৃশ্যপটে ভাসে। তখন জামায়াতে ইসলামীকে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী বা জঙ্গি মনে হয়নি। কারণ, তখন জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছিল। আজ জামায়াত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরোধিতা করছে। তারা আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গী নেই বলে আওয়ামী ভাষায় জঙ্গি হয়ে গেছে। আজ কোন রাজনৈতিক দল জঙ্গি তা দেশবাসী ভালো করেই জানেন। বাংলাদেশে আজ সবচেয়ে জঙ্গির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগ।”
“বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার অধিকার। এই সাংবিধানিক অধিকারবলে তারা যে কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন করতেই পারেন। আন্তর্জাতিক মানের ন্যায়সংগত ও বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত ছাড়াই কোনো রাজনৈতিক দলকে অপবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অন্যায় এবং সংবিধান সম্মত নয়।
সরকার এসব অগণতান্ত্রিক কাজ করে এক দফা আন্দোলন থেকে জনগণের মনোযোগ সরাতে পারবে না। আমরা দল মত নির্বিশেষে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকলকে রাষ্ট্রঘাতি-প্রাণঘাতি সরকারের পতনের আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমরা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।”