আজান না শোনাতে জোরে গান বাজানো হতো আয়নাঘরে
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুর ডিওএইচএস থেকে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হয়। চোখ বেঁধে নেওয়া হয় আয়নাঘরে। সেখানে ২৪ ঘণ্টাই তাঁর হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে রাখা হতো। দিন, সময় ও তারিখ তাঁকে জানতে দেওয়া হতো না। এমনকি আজানের ধ্বনিও শুনতে দেওয়া হতো না। আজানের সময় জোরে মিউজিক বাজানো হতো। এসব নির্যাতনের পর অবশেষে তিনি মুক্ত হন ৬ আগস্ট। আট বছরের অন্ধকার জীবনের সেই ভয়াল অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করেছেন এনটিভির কাছে।
প্রায় আট বছর আরমানকে দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করতে হয়েছে। আট বছরের বন্দিশালার নির্যাতন যেন হার মানায় কল্পিত গল্পকেও। সেই দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আরমান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি জীবন্ত অবস্থায় কবরের মধ্যে থাকছি। আমি যদি জানতাম, আমার সঙ্গে এই আচরণ করা হবে, তাহলে আমি দুটি মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে আসতাম। আমি এতো দ্রুত আলাদা হয়ে যাব, চিন্তাও করতে পারিনি।’
আহমদ বিন কাসেম বলেন, ‘আমাকে বলা হয়নি আমি কোথায় আছি। আমাকে বলা হয়নি, আজকে কত তারিখ। এখন কয়টা বাজে, এটাও তারা বলতো না। আমি বলতাম, আমি নামাজ পড়ব কীভাবে? তখন তারা বলতো, এটাই আদেশ। সময় বলা যাবে না। আশেপাশে মসজিদ ছিল, আজান শোনা যেত। যখনই আজান শোনা যেত, তখনই তারা মিউজিক ছেড়ে দিত। যেন আজান শুনতে না পাই। তারা বলতো, এটাই আদেশ। কেউ যেন সময় বুঝতে না পারে, লোকেশন বুঝতে না পারে। আজান শুনতে না পারে। এভাবে আটটি বছর কেটে গেছে। একমাত্র আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
আরও পড়ুন : পরিবারের কাছে ফিরেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আযমী
কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে ব্যারিস্টার আরমানের। আট বছর পর মায়ের কাছে ফিরে আসাটা আরমানের কাছে কল্পনারও অতীত, স্বপ্নের মতো। আরমানের কাছে সময়টা এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। ২০১৬ সাল আরমানের আকাশ গুটিয়ে যায় পৃথিবীর আলো থেকে। শুরু হয় অচেনা অন্ধকারে চোখবাঁধা এক অধ্যায়ের। জীবনের আটটি বছর কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল আরমানের দুচোখ।
আরমান বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা চোখ ববেঁধে রাখা হতো। নাক থেকে কপাল পর্যন্ত চোখটা বাঁধা থাকতে হবে, যেন সামনে যিনি থাকবেন তাকে দেখা না যায়। এমনকি দিনের আলোটাও যেন দেখা না যায়। এভাবে চোখ বাঁধা থাকার নিয়ম। ২৪ ঘণ্টা হাতকড়া পারানোর নিয়ম। দিনের বেলা সামনে, রাতের বেলা হাতের পেছনে। দিনে বেলা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হাতের সামনে, রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত হাত পেছনের দিকে। শুধু রমজান মাসের চাঁদ রাতে তারা বলতো, আজকে চাঁদ দেখা গেছে, তারাবির নামাজ পড়েন। রমজান মাসে সেহেরি ও ইফতার দেওয়া হতো। কর্মীদের জন্য খাবারের বরাদ্দ যতটুকু, তার হাফ বন্দিদের জন্য বরাদ্দ ছিল।’
ব্যারিস্টার আরমান বলেন, ‘আমি রাতভর কাটিয়েছি, বন্দিদের কান্নার আওয়াজে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে শিশুর মতো চিৎকার করতে শুনেছি আমি। মানুষের চিৎকার ও নির্যাতনের আওয়াজে আমি বহু রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এমন কথাও আমার কানে আসতো, মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। কয়েকজন বন্দি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাদের হাত-পা বেঁধে নাকের নল দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কা হতো, তখন তাদের ভিটামিন ইনজেকশন দেওয়া হতো; মৃত্যু যাতে না হয়। বন্দিদের মৃত্যুর চেয়ে এক খারাপ অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়।’
ব্যারিস্টার আরমান আরও বলেন, ‘২০১৬ সালের আগস্ট মাসের রাতে সাদা পোশাকে এসে তারা আমাকে বলে, আমাদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের সাথে আপনাকে যেতে হবে। আমি জানতে চাইলাম, তারা কারা? তখন আমাকে বলে, একটু কষ্ট করে আমাদের সঙ্গে চলেন। গেলেই বুঝতে পারবেন। আমি যেতে চাইনি। তখন দেখলাম, তারা বল প্রয়োগ করছেন। ঘরে বাচ্চারা রয়েছে, নারীরা রয়েছে। এদের সামনে সিনক্রিয়েট করার কোনো সুযোগ নেই। তখন আমি তাদের কোঅপারেট করলাম। গাড়িতে তুলে তারা আমার চোখ বেঁধে ফেলল। তখন বললাম, আমি তো আপনাদের সাথে কোঅপারেট করছি, চোখ বাঁধছেন কেন? তারা বলেন, এটাই আমাদের নিয়ম। আমি চিন্তা করতে পরিনি, কখনো দুনিয়ার আলো দেখতে পারব। আমার বিশ্বাস ছিল, মৃত্যু এখানেই হবে। আর যদি স্বৈরাচার সরকার থাকতে না পারে, হয়তো যাওয়ার আগে আমাকে হত্যা করে তারপর যাবে।’
আরও পড়ুন : ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত হলেন ব্রিগেডিয়ার আযমী ও ব্যারিস্টার আরমান
আহমদ বিন কাসেম আরও বলেন, ‘যখন আমাকে সেল থেকে বের করে গভীর রাতে, আমি ভেবেছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। পরে আমাকে একটা খোলা প্রান্তরে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামানো হয়। আমি মনে করেছি, এখনই গুলির আওয়াজ শুনব। তারপর আমি আর থাকব না। তারপর জোরে গাড়িটি চলে গেল। এক ঘণ্টা পর আস্তে আস্তে করে চোখটা খোলার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, অন্ধকার একটি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। দু-ঘণ্টা পর আমি হাঁটার পর আমি ওখানে গিয়ে পৌঁছায়। ওখানের লোকজন আমাকে জানায় যে, এটা দিয়াবাড়ি। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাকে দিয়াবাড়ি ড্রপ করা হয়েছে।’
আহমদ বিন কাসেম আরও বলেন, ‘মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার, মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার, মৌলিক সামাজিক অধিকার, মৌলিক ধর্মীয় অধিকার, মৌলিক ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না কখনো।’