আন্দোলনরত মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে গুলিতে মারা যান বাবা
দেশ তখন উত্তাল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাধার সম্মুখীন। দু’হাত প্রসারিত করে বুকে বুলেট নিয়ে মারা গেছেন আবু সাঈদ। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। এমন রক্তঝরা দিনগুলোর একটি ১৯ জুলাই (শুক্রবার)। সেদিন আন্দোলনে ছিলেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিন আক্তার চাঁদনি (১৮)। মেয়ের বুকে বুলেটবিদ্ধ রক্তের দাগের দুঃস্বপ্নকে সত্য হতে দেবেন না বলে চিন্তিত বাবা গিয়েছিলেন চাঁদনিকে ফিরিয়ে আনতে। তারপর আর ফেরা হয়নি তাঁর।
১৯ জুলাই জুমার আগে চা বিক্রেতা বাবা মো. কামাল রাজধানীর কাজীপাড়ার কৃষিবিদ গলির বাসায় যান। স্ত্রী সেতারার কাছ থেকে জানতে পারেন, মেয়ে চাঁদনি মিরপুর-১০-এ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গেছেন। শুনে কামাল সেতারাকে বলেন, ‘নামাজ পড়ে চাঁদনিকে বাসায় আনতে যাব।’ এরপর তিনি মসজিদে নামাজ আদায় শেষে মিরপুর-১০-এ যান। কিন্তু, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়। কামালের দেখা মেলে না। রাত ৮টার আগেই বাসায় ফেরেন চাঁদনি। মা সেতারা জানতে চান, ‘তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি?’ হতভম্ব চাঁদনি। না, তার সঙ্গে বাবার দেখা হয়নি—জানান মাকে।
মো. কামাল মুঠোফোন ব্যবহার করতেন না। সঙ্গে আর কেউ ছিলেন কি না, তাও জানা ছিল না কারও। দেশের ওমন এক পরিস্থিতিতে রাত ৮টার দিকে বড়বোন শারমিন আক্তার ও মাকে সঙ্গে নিয়ে বাবার খোঁজে বের হন চাঁদনি।
চাঁদনি বলেন, বাবার যখন আমাকে খুঁজতে বের হওয়ার কথা ছিল, তখন দুপুর। সে সময় চারিদিকে গুলিগোলা আর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলছিল। তিনি বলেন, বাবা আমাকে খুঁজতে গেলেও আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। বাবার কাছে ফোন ছিল না। আবার হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে। বাবা আমাকে খুঁজে পাননি। আর রাতে বাবাকে খুঁজতে আমরা কাজীপাড়া ও মিরপুর এলাকায় বের হই। কিন্তু, কোথাও পাইনি। কেউ বলতে পারে না, বাবা কোথায় গেছেন। আমি বাসায় ফিরে এলেও আসেননি বাবা।
শারমিন আক্তার বলেন, রাতে আমরা বেশি খোঁজাখুঁজি করতে পারিনি। কারণ, ওই রাতেই সরকার কারফিউ জারি করে। রাস্তায় থাকা সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের জানান, সকালে খুঁজতে বের হতে। পরে আমরা বাসায় যাই। সকালে বের হয়ে নানা স্থানে যাই। কিন্তু, কেউ খোঁজ দিতে পারে না। পরে একটি প্রতিষ্ঠানের নৈশ প্রহরী সকাল ৮টার দিকে আমাদের বলেন, আজমল হাসপাতালে কয়েকটি মরদেহ দেখেছেন। পরে আমরা সেই হাসপাতালে যাই।
শারমিন আক্তার বলেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে দেখি, রিসেপশনের পাশে একটি লাশ ফ্লোরে পড়েছিল। আর ট্রলিতে ছিল আমার আব্বার লাশ। আমরা ছবি ও কাগজপত্র দিয়ে আব্বার লাশ শনাক্ত করি। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, শুক্রবার বিকেলে ৪টার দিকে লাশ সেখানে পৌঁছায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই আব্বা মারা যান। তখন আমাদের দ্রুত লাশ নিয়ে চলে যেতে বলা হয়। হাসপাতাল থেকে বলা হয়, পুলিশ কেস হবে। তখন ঝামেলা বাড়বে। এর চেয়ে দ্রুত লাশ নিয়ে চলে যান। সে সময় হাসপাতাল থেকে আমাদের ডেথ সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়নি। তবুও লাশ নিয়ে বের হয়ে যাই আমরা। এরপর জানাজা শেষে ২০ জুলাই আসরের পর মিরপুর বাংলা স্কুলে বাবার লাশ দাফন করি।’
মো. কামালের চার মেয়ে। তাঁর ছেলে নেই। চাঁদনি বাদে বাকি তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তিন মেয়েই তাঁদের জামাইয়ের সংসারে থাকেন।
সেতারা বলেন, ‘মেয়েকে খুঁজতে গিয়েছিল আমার স্বামী। তাকে হারালাম। আল্লাহ এর বিচার করবেন। আমাদের আর আয়ের লোকজন নেই। আমার মেয়ের পড়ালেখার কী হবে, তাও জানি না। আমরা চাই, আমাদের কথা সরকার পর্যন্ত শুনুক। আমরা নতুন সরকারের সহযোগিতা চাই। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমার মেয়ের পড়ালেখার নিশ্চয়তা চাই।’
মো. কামালের ডেথ সার্টিফিকেট এখন তার পারিবারের হাতে। মৃত্যুর কারণে লেখা আছে, ‘তিনটি গুলি...।’ অথচ, সেদিন ডেথ সার্টিফিকেট পাননি চাঁদনি। ‘ঝামেলা’র দোহায় দিয়ে তথ্য প্রচারে নিরুৎসাহিত করা হয় তাদের। চাঁদনি বলেন, আমরা সে সময় চেয়েছিলাম এ ঘটনা প্রচার হোক। কিন্তু, এলাকার দু-একজন বলেছিলেন, থাক কিছু করার দরকার নেই। ঝামেলাও হতে পারে। মারা তো গেছেই, মাটি দিয়ে ফেলান।’