পুলিশের গুলিতে মঞ্জয়ের ঝাঁঝরা হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল
পুলিশের গুলিতে ছিন্নভিন্ন ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা চোখে হাজারও প্রশ্ন, সঙ্গে নানা অনিশ্চয়তা। ‘আমি কী অন্যায় করেছিলাম! কেন আমাকে কাছ থেকে এভাবে গুলি করে হাতটি ওরা কেড়ে নিলো? এমন অসংখ্য প্রশ্ন দিনভর মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় তার।
১৬ বছর বয়সী কিশোর মঞ্জয় মল্লিক কথার স্বাধীনতা আনতে গিয়েছিল সেদিন। আনতে গিয়েছিল বেঁচে থাকার অধিকার, ভোটের অধিকার। যে দিনটি এখন ঐতিহাসিক, সেই ৫ আগস্ট দিনটিতে কিছু পুলিশ সদস্য তার জন্যও গড়ে দিল ইতিহাস। হারানোর ইতিহাস। না, অন্য কিছু হারায়নি সে, হারিয়েছে নিজের হাত।
অভাব দারিদ্রের সঙ্গে বেড়ে ওঠা মঞ্জয় সাভারে প্রেসক্লাবে পিওনের কাজ করতেন। বেতন পেতেন সাকুল্যে মাত্র ৯ হাজার টাকা। বাবা কাঠমিস্ত্রী। পুলিশের নির্বিচার গুলির প্রতিবাদে গত ৪ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সাভার থানার দিকে অগ্রসর হলে প্রেসক্লাব সংলগ্ন মুক্তির মোড়েই তাদের ঠেকিয়ে দেয় পুলিশ। শুরু হয় পাল্টাপার্টি ধাওয়া আর সংঘর্ষ। একপর্যায়ে পুলিশ পিছু হটলে তাদের ক্ষোভের ঝাল মেটানো হয় প্রেসক্লাবে। ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয় সেখানে।
পরদিন গণ-অভ্যুত্থানে জেগে আছে তখন বাংলাদেশ। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার খবর তখনও মেলেনি। যথারীতি প্রেসক্লাবে গিয়ে ধংসস্তূপ অপসারণ করছিলেন মঞ্জয়। একপর্যায়ে কিছু যুবক প্রেসক্লাবে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মঞ্জয় বলেন, আমি ভয়ে-আতঙ্কে ক্লাব থেকে বের হয়ে থানার দিকে প্রাণভয়ে দৌঁড়াতে থাকি। এ সময় নিকট দূরত্বে পৌঁছে দেখি, সাভার থানার পুলিশ গুলি করতে করতে প্রেসক্লাবের দিকে আসছে। আমি পড়ে গেলাম তাদের মধ্যে। এ সময় ছোট্ট একটি গলির ভেতরে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে পুলিশও সেখানে ঢুকে পড়ে। নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এ সময় পুলিশের এক কনস্টেবল তার অস্ত্র তাক করে আমাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমি ভয়ে সিটকে পড়ি। পুলিশকে বলি, ভাই আমি প্রেসক্লাবের পিওন, ছাত্র না! তারপরও আমার দিকে তাক করা অস্ত্র ঘুরিয়ে গালি দিয়ে বলেন, ভাগ এখান থেকে। আমি দৌড় দিতেই সেই পুলিশ পেছন থেকে আমাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। গুলি এসে লাগে আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচে। অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়েছিলাম।
মঞ্জয় আরও জানান, গুলি লাগার এক-দেড় ঘণ্টা পর সংঘর্ষ থেমে গেলে স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। ওদিনই চিকিৎসকেরা তার হাত কেটে ফেলেন।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসক রাজ বলেন, ‘গুলিতে মঞ্জয়ের ডান হাতের কনুইয়ের নিচ গুলি লেগে হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল হাতের ওই অংশের সব নার্ভ। এজন্য শত চেষ্টা করেও আমরা তার হাত রক্ষা করা করতে পারিনি। জীবন সংশয়ে পড়ায় তাই হাতটিই কেটে ফেলতে হয়েছে।’
মঞ্জয়ের বাবা রঞ্জিত মল্লিক বলেন, ‘এই গন্ডগোলে বেশ কয়েকদিন ধরে কাজ বন্ধ। আগের মতো কাঠের কাজও নেই। ঘর ভাড়া দেওয়ার পর সংসার চালানোই কষ্টের। ছেলেডারে সাভার প্রেসক্লাবে কাজে দিছিলাম। দুজনের টাকায় কোনোভাবে সংসার চলত। এখনতো ভীষণ বিপদে পইড়া গেলাম। হাত ছাড়া তো ও আর কাজও করতে পারবো না।’
মঞ্জয়ের মা জোসনা মল্লিক বলেন, ‘ট্যাকার লাইগ্যা পোলাডোরে পড়াইবার পারি নাই। তাই কাজে দিছিলাম। গুলি লাইগ্যা হেই পোলা আমার সারা জীবনের জন্য পঙ্গু অইয়া গেল। কার কাছে বিচার দিমু। আমাগো বিচার করার কে আছে! ভগবানই সব দেখতাছে। আর তার বিচার হইলেই বা কি! কিশোর পোলাডার কি হাত ফিইর্যা আইব?’