‘ভাই, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান প্লিজ’
“আমরা তখন নিউমার্কেট পেট্রোল পাম্পের সামনে। ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলছে। গুলির শব্দ হচ্ছে মুহুর্মুহু। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে সেজদার ভঙ্গিতে উঁবু হয়ে বসে আছে। ততক্ষণে আমাদের ছাড়িয়ে পুলিশ আরও সামনে চলে গেছে। দৌঁড়ে গেলাম ছেলেটার কাছে। আঁকড়ে ধরলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান, প্লিজ।’ একথা বলতে না বলতেই আমার গায়ে শরীর এলিয়ে দিল।”
“আমরা দ্রুত একটা রিকশা নিলাম। তখনও বেঁচে ছিল ছেলেটা। ওর আঙ্গুল দিয়ে ওর ফোন আনলক করালাম। গলায় ঝুলানো আইডি কার্ডে লেখা দেখলাম, ‘সাইদুল ইসলাম শোভন, কলেজ শেখ বোরহানউদ্দিন’। ডায়ালের নম্বর লিস্ট থেকে একটা নম্বরে কল দিয়ে জানালাম, শোভনের গুলি লেগেছে। ওকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি, তার পরিবারকে যেন খবর দেওয়া হয়। যাওয়ার পথে শোভন একটা বড় নিঃশ্বাস নিল। আশঙ্কা হলো—শোভন মারা গেছে।’
‘হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওখানে আহত-নিহত মানুষের ছড়াছড়ি। চারদিকে কান্নাকাটি আর হুড়োহুড়ি। একজন ডাক্তার পার্লস দেখে বললেন—আগেই মারা গেছে।’
শোভনকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আলমগীর হোসেন। চকবাজারের একটি দোকানের সেলসম্যান তিনি। সেদিন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন আলমগীরও। দিনটি ছিল ১৯ জুলাই।
জানা গেছে, বিক্ষোভরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সাইদুল ইসলাম শোভন। শোভন গত বছর শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পড়াশোনার জন্য তার জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। কাগজপত্র ও প্রায় রেডি। কিন্ত আর যাওয়া হলো না তার। তার আগেই চলে গেল না ফেরার দেশে।
শোভনের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। শোভন দুপুরে বিরিয়ানি খাচ্ছিল, ওর বন্ধুরা তখন বার বার ফোন দিচ্ছিল। ছেলেটা আমার তাড়াহুড়া করে খেয়ে চলে গেল...আমি কি জানতাম, ওটাই আমার ছেলের শেষ খাওয়া!’
সন্ধ্যার দিকে পাশের বাড়ির এক ছেলে এসে বলে, ‘আন্টি শোভনের গুলি লেগেছে, ওকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হইছে।’
‘ওর বাবা তখন ইন্ডিয়াতে। পাগলের মত ছুটে গেলাম হাসপাতালে...গিয়ে দেখি ইমার্জেন্সির এক কোণায় একটা ট্রলিতে আমার শোভন পড়ে আছে, কয়েকটা ছেলে ওর পাশে দাঁড়ানো... শোভনের কাছে দৌঁড়ে গেলাম, আমার ছেলের দেহ নিথর। কত্ত ঝাঁকুনি দিলাম, ছেলে কিছু বলে না। আমার শোভন তখন আর নেই!’ একথা বলে ঢুকরে কেঁদে ওঠেন শাহনাজ।
‘ছেলে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে মারা যাওয়ায় ভয় হচ্ছিল, যদি পুলিশ লাশ নিয়ে যায়...যদি আমাদেরকে এরেস্ট করে! তাই ময়না তদন্ত ছাড়াই তাড়াহুড়া করে আমার ভাইদের আর ওর বন্ধুদের সহয়তায় কোনোমতে জোর করেই হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে এলাম।’
কয়েক বছর আগের এক ২১ ফেব্রুয়ারি দিন, শোভন তখন ক্লাস সেভেনে বা এইটে পড়ে। সেদিন শোভন একটা পোস্টার বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। ওই পোস্টারটিতে ছিল পাঁচজন ভাষা শহীদ: সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার, শহীদ মিনারের আঁকা একটা ছবি আর ছিল শোভনের নিজের ছবি। সময়ের পরিক্রমায় সেই পোস্টারের সব চরিত্র আজ এক, তারা সবাই শহীদ। দেশের জন্য সবাই রাজপথে জীবন দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা শোভনের শাহাদাত নির্ধারিত করে রেখেছিলেন বলেই কি ওই পোস্টারের সব চরিত্র এক হয়ে গেল!
শোভনের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘আমরা তো জানতাম না, আমার ছেলে দেশের প্রতি এই রকম ভালোবাসা ছিল। ও যে নিজেই দেশের জন্য পোস্টারের আরেকজন শহীদ হয়ে গেল!’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘শোভন মারা যাওয়ার পরে ওরে ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমরা এই পোস্টারটি দেখি, তবে কি শোভন এমনভাবেই শহীদ হতে চেয়েছিল কিংবা সৃষ্টিকর্তা শোভনের ভাগ্যে আগেই শাহাদাত লিখে রেখেছিল?’
শোভনের বাবা নজরুল ইসলাম। পেশায় ব্যাবসায়ী। তিনি বলেন, ‘কত্ত স্বপ্প ছিল ছেলেটাকে নিয়ে, সব শেষ হয়ে গেল। আমার সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেল! জানি না বাকি জীবনটা কীভাবে কাটবে আমাদের!’
‘সরকারের কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। শোভন দেশের জন্য যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মারা গেছে—শোভন যেমন দেশ চেয়েছিল সেরকম হোক এই দেশটা। দেশের মানুষ যেন আমার সন্তানকে মনে রাখে, ওর আত্মত্যাগের কথা ভুলে না যায়।’
বোরহানউদ্দিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘শোভন খুব সাহসী ছিল। সে আমাদের জাতীয় বীর। শোভনের মত তরুণদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই এই দেশের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আমরা এই জাতীয় বীরদের অবদান ভুলব না। শোভনের স্মরণে চান খার পুল চত্বরকে ‘শোভন চত্বর’ নামকরণ করা হয়েছে। শোভন সবার জন্য এক অনুকরণীয় চরিত্র।’ তিনি শোভনের জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা যেন শোভনকে জান্নাত নসিব করেন।’