নিয়ন্ত্রণে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির আগুন, নিখোঁজের তালিকায় ১৭৪
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির আগুন ২১ ঘণ্টা পর আজ সোমবার (২৬ আগস্ট) ৭টা ৫ মিনিটের দিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন চলছে ডাম্পিং। এদিকে বিকেল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ১৭৪ জন নিখোঁজ হওয়ার তালিকা সংগ্রহ করেছে স্বজনদের কাছ থেকে।
এর আগে উপজেলার তারাবো পৌরসভার রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানার আগুন লাগে। মুহূর্তে আগুন পুরো ফ্যাক্টরিতে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। ফায়ার সার্ভিসের ১২০ সদস্যের নেতৃত্বে ১২টি ইউনিট রোববার রাত থেকে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। এরমধ্যে আহত অবস্থায় কারখানার ভেতর থেকে ১৪ জনকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষক) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম জানান, ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফ্যাক্টরিতে টায়ার তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল, দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যাল থাকায় আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়েছে। তবে কীভাবে আগুন লেগেছে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্তের পর বলা যাবে।
রেজাউল করিম আরও বলেন, শুরুতে আমরা ভেতর থেকে আটকে পড়া ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে অনেকে আমাদের জানাচ্ছেন তাদের স্বজন নিখোঁজ। তারা ভেতরে আটকা পড়েছেন। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন নিখোঁজের তালিকা করেছেন। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৭৪ জন নিখোঁজের তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা। আমরা উদ্ধার কাজ এখনো শুরু করতে পারিনি। কারণ ভবনটিতে অস্বাভাবিক আগুনের তাপ রয়েছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলেই উদ্ধার কাজ শুরু করা হবে।
এদিকে নিখোঁজদের কেউ কারখানার শ্রমিক নন বলে দাবি কারখানা কর্তৃপক্ষের। কারখানায় হামলা চালিয়ে লুটপাট কিংবা অন্য কোনো কাজে তারা এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওদিকে নিখোঁজদের খোঁজে কারখানার সামনে স্বজনেরা ভিড় জমিয়েছেন। এমন অন্তত ২০ জন স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলছেন, গতকাল বিভিন্ন সময় তাদের স্বজনেরা কারখানায় এসেছেন। তারা কেউই কারখানার শ্রমিক নন। পরে আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাত থেকে মুঠোফোনও বন্ধ।
কারখানার সামনে দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি বলেন, তার স্বামী মো. সজিব (২৬) গত রাত ৯টা থেকে নিখোঁজ। সজিব উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজিব রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন জানিয়ে রুবি বলেন, ‘কারখানায় লুটপাট হইতাছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত ৯টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায়ই ছিল। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’
নিখোঁজের তালিকায় নাম আছে একটি অ্যাগ্রো ফার্মের রাখাল মো. শাওন (১২), একটি সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক আবদুর রহমান (৩০), ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সুজন (২৮), তার বোন মাফিয়া বেগম (৩০), বোনের স্বামী মো. রতন (৩৫), বড়ালু এলাকার রাজমিস্ত্রি হাসান আলী (৩২), তার দুই বন্ধু অহিদ (৩২), রুবেল (৩০), মুদি দোকানি শাহাদাত সিকদার (২৯), তাঁর ভাই সাব্বির সিকদারসহ (২৫) অনেকে।
ফ্যাক্টরির শ্রমিক তরিকুল ইসলাম জানান, তিনি ১৭ বছর ধরে ওই কারখানায় চাকরি করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাদের একটা ফ্যাক্টরিতে আগুন দেওয়া হয়। এরপর কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। টায়ার কারখানায় তারা ৫০ জন শ্রমিক দিনরাত পাহারায় ছিলেন। গত রোববার সকালে গাজী গ্রুপের কর্ণধার সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল ৬টার দিকে বিপুল সংখ্যক লোকজন ফ্যাক্টরিতে ঢুকে লুটপাট শুরু করে। লুটপাটের এক পর্যায়ে ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। টায়ার তৈরীর সকল কাঁচামাল, কেমিক্যাল, পিতল তামা, রাবার মজুদ ছিল এই ফ্যাক্টরিতে।
ওদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফ্যাক্টরির কয়েকজন শ্রমিক জানায়, দুই গ্রুপ লুটপাট করতে আসে। এক পর্যায়ে দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটির সূত্র ধরে মারামারি হয়। এক গ্রুপের লোকজন উত্তেজিত হয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে করে লুট করতে আসা অনেকেই ভেতরে আটকা পড়ে যায়।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান মাহমুদ বলেন, আগুন লাগানো ও লুটপাটের ঘটনায় সরকার ব্যবস্থা নেবে। নতুন করে কেউ যেন লুটপাটে না জড়ায়, সে বিষয়ে তারা সতর্ক আছেন। স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়েছে কেউ যেন নতুন করে কোন প্রকার লুটপাটে না জড়ায়।