আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে নানা উদ্যোগ-পরিকল্পনা
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের তিন মাস আজ। এ তিন মাসের পুরোটা সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত সময় কেটেছে সরকারের। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে দেশের শৃঙ্খলা খাত। থানায় থানায় হামলার ঘটনা ঘটে, লুট হয়ে যায় অস্ত্র, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে পুলিশ। নিজেদের বাঁচাতে পুলিশ লাইনসে অবস্থান নেয় তারা। হত্যা-চুরি-ডাকাতির ভয়ে সন্ত্রস্ত জনতা এক হয়ে লড়ে সেই সেই পরিস্থিতি। সড়ক সামাল দিতে নামে শিক্ষার্থীরা। পরে নানা উদ্যোগ আর পরিকল্পনায় কিছুটা হলেও স্বস্তির পথ পেয়েছে এই সরকার।
৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ব্যস্ততা ছিল পুলিশ বাহিনীকে থানায় ফেরাতে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা। দেশের অধিকাংশ থানা, জেলা ও মহানগর পুলিশে ব্যাপক রদ-বদল আনে সরকার। তারপর পুলিশ থানার কার্যক্রম চালাতে ভয় পাচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটে সারা দেশের পুলিশ সরকারের কাছে পুলিশ সংস্কারে ১১ দফা দাবি জানায়। পুলিশের দাবি ছিল, ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। অথচ, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ক্ষোভের শিকার হচ্ছে কেবল নিচের পদের পুলিশ সদস্যরা।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন থানা রক্ষার দায়িত্বে কাজ করতে থাকে সেনা সদস্যরা। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে আহ্বান জানানো হয়, পুলিশকে সহযোগিতা করতে। আহ্বানে বলা হয়, ‘পুলিশকে সহযোগিতা করুন, পুলিশের কাছ থেকে সেবা নিন।’ একপর্যায়ে পুলিশকে থানা পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব হলেও দৃশ্যত মাঠের কাজে তাদের পাওয়া যায়নি। পুলিশ থানায় অবস্থান নিলেও মামলা গ্রহণ করছিল না। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় বড়জোর জিডি নেওয়া হচ্ছিল। তখনও ট্রাফিক পুলিশকে মাঠে নামাতে পরেনি সরকার। ছাত্র-জনতা সড়কে নেমে ট্রাফিকের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এরপরও পুলিশের একটা অংশ কাজে যোগদান করছিল না। তবে, তাদের কাজে ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১১ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘১৫ আগস্টের মধ্যে পুলিশ সদস্যরা যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না।’
এর আগেও পুলিশ যেন কাজে ফেরে, তার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তারপরও শেষমেশ ১৮৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা কাজে যোগাদান করেননি। পরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। তিনি জানিয়েছিলেন, কাজে যোগ না দেওয়া ১৮৭ জন পুলিশ সদস্যকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এই পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে, ৩০ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় জানানো হয়, শুধু সেনাবাহিনী নয়, সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) সব কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আগের প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে দখলদারিত্ব-মারামারি-ছিনতাই-ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। এখনও পুলিশ বাহিনীকে সেভাবে মাঠে সক্রিয় করা যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্তির আগের রাতে, অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রেজাউল করিম নামের এক কনস্টেবলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। রেজাউল রাতে ট্রাফিক পুলিশের টহল ডিউটিতে ছিলেন। গত ৩১ অক্টোবর তার বদলির অর্ডার হয়েছে। তবে, তাকে এখনও বদলির ঠিকানায় পাঠানো হয়নি। রেজাউল এ প্রতিবেদকের দাবি করেন, ‘আমাকে যে পাঠাবে, আমার জায়গায় লোক লাগবে না? ঢাকায় আওয়ামী সরকারের আমল থেকে ছিল, এমন অনেককে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু, জেলা থেকে তো সেভাবে পুলিশ আসেনি এখনও। পুলিশ না এলে, ঠিকঠাকভাবে ডিউটি করবে কীভাবে? এই যে কোথাও পুলিশ নেই টাইপের ভাব, এর মধ্যে মানুষ বিপদে পড়লে বা ছিনতাইকারীর আক্রমণে পড়তে তাকে কে বাঁচাবে?’
জানতে চাইলে পুলিশের একজন উপকমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকার সব ধরনের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। তিন মাস ধরেই এ ব্যাপারে সরকারের চেষ্টার অন্ত নেই। তবে, পুলিশের মনোবল এখনো ঠিক হয়নি। সেপ্টেম্বর-আগস্টে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। পুলিশের বড় একটি অংশ তো আওয়ামী লীগের সমর্থক। যাদের গত ১৫ বছরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের তো ভয় রয়েছে। সেজন্য, ঠিকঠাকভাবে মাঠে নামানোতে অসুবিধা হচ্ছে। আর এখন জনগণও পুলিশকে ঠিকভাবে সহযোগিতা করে না। পুলিশ মূলত ভয় পায়। আর ডিএমপিতে এই মুহুর্তে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই সব সময় ডিউটি করানোর মতো। আমার ধারণা, পরিস্থিতি দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে।
রেজাউল করিম বললেন, ‘সারা ঢাকা ঘুরে দেখেন, কোনো ট্রাফিক বক্স খোলা নেই। মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই। পুলিশ আছে কেবল টহল টিমে। এ পরিস্থিতি কবে ভালো হবে, বড়বড় স্যারেরা জানেন।’ তার কথা শুনে রাজধানীর চারিদিকে ঘুরে দেখার চেষ্টা করা হয় পরিস্থিতি বোঝার জন্য। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার সময় রাজধানীর শাহ আলী থানার সামনে থেকে মিরপুর এক হয়ে টেকনিক্যাল মোড় দিয়ে কল্যাণপুর-শ্যামলী পর্যন্ত গিয়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি। পরে শিশু মেলা হয়ে আগারগাঁও-বিজয় সরণি পাড়ি দিয়ে ফার্মগেটে গিয়ে প্রথম দুজন ট্রাফিক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। সেখান থেকে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা মেলা যৌথ বাহিনীর সদস্যদের। এরপর সায়েন্সল্যাব মোড় ঘুরে শাহবাগ পর্যন্ত গিয়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
শাহবাগ মোড়ে কয়েকজন মেট্রোরেলের কর্মীদের কাজ করতে দেখা যায়। শাহবাগ মোড়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই এমন কথাপোকথনের মধ্যে তাদের একজন বলেন, এখন আমরাই পুলিশের দায়িত্ব পালন করছি।’ সেখানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে গিয়ে দেখা মিলল এক মানসিক প্রতিবন্ধীর। রাত তখন একটা। ওই নারীর পায়ে শিকল বাঁধা। তিনি রাতে চলা গাড়ির সামনে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ওই রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে এ দৃশ্য দেখেন রাকিব হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। পরে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করেন। কিন্তু, ৯৯৯ থেকে তাকে জানানো হয়, এই রাতে তাদের কোনো নারী টহল টিম নেই। সেজন্য, পাঠাতে পারবেন না। ৯৯৯ থেকে রাকিবকে পরামর্ম দেওয়া হয়, হাসপাতালে রেখে আসতে। কিন্তু, ওই নারী তাদের সঙ্গে যেতে চান না। পরে রাকিব শাহবাগ থানায় কল করেন। কিন্তু, শাহবাগ থানা থেকেও পুলিশকে সেখানে দেখা যায়নি।
পরে বাধ্য হয়ে রাকিব ওই নারীকে থানা পর্যন্ত রেখে তার বংশালের বাসায় যান। ঘটনাগুলো যখন ঘটে, তখন এ প্রতিবেদক পাশে ছিলেন। রাকিব হোসেন বলেন, ‘নানা অযুহাতে পুলিশ কোনোরকম সহযোগিতা করতে চাই না। দেশে কী একটা অবস্থা চলছে।’
সে সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ছিলেন আবু তাহের নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী। সড়কে কোথাও পুলিশ না থাকা এবং পুলিশকে ডেকেও না পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ অনেক ভালো। সরকারকে সহযোগিতা না করলে গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর যে অবস্থা, তাতে দেশের অবস্থা হতো আরও ভয়াবহ।’
শুধু এ ঘটনা নয়, পুলিশের এ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটিয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘর্ষ-হত্যা-চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ বেড়েছে। এই তো, গত ৬ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ধর্মীয় সংগঠন নিয়ে দেওয়া পোস্ট শেয়ার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানা এলাকায় যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে একদল বিক্ষোভকারীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে সাত পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে একজন সামান্য অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন।
একের পর এক অভিযান, তবুও ভয়ঙ্কর মোহাম্মদপুরে
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শাহাদত হোসেনকে (২৪) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে (এফ এইচ হল) চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে। এ ছাড়া ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে নাসির বিশ্বাস (২৩), মুন্না হাওলাদার (২৪) ও নূর ইসলাম (৫০) নামের তিনজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এসব হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি রাজধানীসহ সারাদেশে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই উত্তাল ছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর। রাজধানীর যে পাঁচ স্থানে বেশি আন্দোলন ও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটেছে, তার মধ্যে একটি মোহাম্মদপুর থানা এলাকা। আবার সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা দায়ের হয় এই এলাকায়। গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে ১২ বর্গ কিলোমিটারের এ এলাকা। যাতে ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে কয়েকজনের, আহত প্রায় অর্ধশত। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। কারণ, এখানে ছিনতাই-ডাকাতি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে রয়েছে—১১ অক্টোবর বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসায় ও কার্যালয়ে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে ডাকাতি করে। ২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে ছয়জন ছিনতাইকারী অস্ত্রের মুখে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ২৫ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের বছিলার গার্ডেন সিটি এলাকার একটি সুপারশপে মুখোশ পরা ডাকাতেরা চাপাতি দেখিয়ে কর্মচারীদের জিম্মি করে টাকা লুট করে। এ ছাড়া অস্ত্রের মুখে নারী শিক্ষার্থীর ব্যাগ কেড়ে নেওয়া, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে একের পর এক হত্যার ঘটনা; জেনেভা ক্যাম্পের গোলাগুলি ও নিয়মিত চুরির ঘটনা বেড়েছে। এ ছাড়া গণছিনতাইয়ের ঘটনা নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকালও মোহাম্মদপুরে হানিফ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে মুঠোফোন ছিনতাই করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও থানা পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, মোহাম্মদপুরের রিং রোড এলাকার পূর্ব পাশে ছিনতাইয়ের কোনও ঘটনা নেই। একই চিত্র শিয়া মসজিদ হয়ে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডের পূর্ব পাশেও। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে বেড়িবাঁধ এলাকার পশ্চিম পাশে। তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—চাঁন মিয়া হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি, নবোদয় হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং, শেখেরটেক, রফিক হাউজিং, আদাবর ১০ ও ১৬ নম্বর সড়ক।
মোহাম্মদপুর থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিগত সরকারের সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় ছিল। নেতারা নিজেদের প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করতেন। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে কিশোর গ্যাং সদস্যদের রক্ষায় নিয়মিত তদবির করতেন অনেকে নেতা। এর পেছনে অন্যতম কারণ, ছিনতাই করা মালামাল কিনতেন নেতাদের একাংশ। আবার বড় ধরণের ছিনতাই থেকে ভাগও পেতেন অনেক নেতা। কিশোর গ্যাংয়ের ওইসব সদস্যরা এখনও এলাকায় সক্রিয়। ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশি তৎপরতা বেশি না থাকার কারণে তারা ছিনতাই-ডাকাতি বাড়িয়ে দেয়। তবে, এর বাইরেও অনেকে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে।
স্থানীয় বাসীন্দাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোর না হওয়ায় কমছে না অপরাধ। সরকারের পক্ষ থেকে নিষ্ক্রিয় পুলিশকে সক্রিয় করার জোর চেষ্টা চালানো হয়। এরপর পুলিশ থানায় দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে, মাঠের চিত্র হচ্ছে, যথাযথভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। আর জীবন ও মাল-সামানা খুইয়ে এর খেসারত দিতে হচ্ছে নাগরিকদের।
৮ দিনে গ্রেপ্তার ১৮০, মোট গ্রেপ্তার ৬০০
তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও থেমে নেই। যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে নিয়মিত। ছিনতাই আতঙ্কে এ এলাকায় সেনা ক্যাম্পও বসানো হয়েছে। নিয়মিত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের। ৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৬০০ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান। এর মধ্যে ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮০ জনকে। ওসির দাবি, গড়ে প্রতিদিন অন্তত আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারপরও আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ তদারকি করা হচ্ছে। স্থানীয়দের সচেতন করা হচ্ছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অন্দাজ করলেই পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যদিও, স্থানীয়দের ভাষ্য, চোখের সামনে ছিনতাই হলেও কিছু বলার থাকে না। কারণ, কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে গেলে তাকেও টার্গেট করা হয়।
ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে চান না এলাকাবাসী
মোহাম্মদপুরে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেন একজন। তিনি একবার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ছিনতাই করা দেখে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এর জন্য তাকে খেসারত দিতে হয়েছিল। ফরিদ উদ্দিন নামের ওই ব্যবসায়ী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আমি দুজনকে চিনি, যারা নিয়মিত ছিনতাই করছিল। তাদের এ ব্যাপারে নিষেধ করে ধমক দিয়েছিলাম। পরের দিন আমার কাছে কয়েকজন ছিনতাইকারী আসে। তারা আমাকে নানা ধরনের হুমকি দেয়। পরে আমি বলি, আমার ভুল হয়েছে। এরপর তারা চলে যায়। তারপর থেকে আর কখনো এসব ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করিনি।
মোহাম্মদপুরে ১০ থেকে ১২ ছিনতাইয়ের গ্রুপ
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ বলছে, মোহাম্মদপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১০ থেকে ১২টি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয় আছে। এ ছাড়া কোনো গ্রুপের নিয়মিত সদস্য নন, এমন অর্ধশত কিশোর ও যুবক ছিনতাইয়ে নেমেছে অস্ত্র হাতে।
তবে স্থানীয়রা বলছে, শতশত ব্যক্তি মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাইয়ে জড়িত। মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শতশত ছিনতাইকারী রয়েছে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকায়। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলেও অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে আনোয়ার নামের একটি গ্রুপ। লোকমুখে শোনা যায়, তারা কব্জিকাটা গ্রুপ নামে পরিচিত। মূলত তারা একটি গ্যাং হিসেবে কাজ করে। এ গ্রুপের হাতেই কিছুদিন আগে আরেক কিশোর গ্যাং লিডার ফাইটার বিল্লাল খুন হন। আনোয়ার গ্রুপ অনেক ছিনতাইকারী নিয়ন্ত্রণ করে। মোহাম্মদপুরের সবচেয়ে বড় গ্রুপ সাজ্জাদ গ্রুপ। এই গ্রুপের সব সদস্যের বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সুবাদে এই গ্রুপ প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সম্প্রতি সময়ে ছিনতাইয়ে সক্রিয় হয়েছেন এই গ্রুপের সদস্যরা।
মোহাম্মদপুর থানার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ১ থেকে ২৫ অক্টোবর অর্থাৎ গত ২৫ দিনে মোহাম্মদপুর থানায় চারটি হত্যাকাণ্ড, একটি ছিনতাই ও দুটি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে এ থানায় ১৭ খুন ও ১টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়।
স্থানীয়দের থানা ঘেরাও, ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
গত ২৫ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানে হঠাৎ করেই ২০-২৫ জন দুর্বৃত্তের একটি দল গণছিনতাই করে মানুষজনকে কুপিয়ে আহত করে। একই দিনে বসিলায় ঘটে আরও দুটি ডাকাতির ঘটনা। এ ছাড়া এ দিন বিকেলে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনায় শিশুসহ তিনজন আহত হয়। পরের দিন ২৬ অক্টোবর বিকেলে গত দুমাস ধরে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে মোহাম্মদপুর বিকেলে থানা ঘেরাও করেন স্থানীয়রা। সে সময় মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনার আলটিমেটাম দেন স্থানীয়রা। পালন করেন অবস্থান কর্মসূচিও। কর্মসূচিতে স্থানীয়রা জানান, ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মোহাম্মদপুরবাসী নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। সে সময় থানা পুলিশ স্থানীয়দের আশ্বস্ত করেন এভাবে, জনগণের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবেন তারা। যদিও তারপরও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ব্যর্থতা স্বীকার পুলিশের
অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেছিলেন, ‘আমার থানায় জনবল কম আছে, এটা সবসময় থাকে। এখন হয়ত আরও একটু কম আছে, আমার গাড়ি কম আছে। এগুলো কোনো এক্সকিউজ হতে পারে না। আমি যখন এই পোশাকে (পুলিশের পোশাক) এসেছি, আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে নিরাপত্তা দেওয়া। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করতেছি, আমি সেক্ষেত্রে ব্যর্থ।’ পরে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তারা সবাই মিলে চেষ্টা করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটনানোর। সেটার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করছেন। তার দাবি, মোহাম্মদপুর এলাকায় এখন আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় রয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকার পরিবেশ তখন খুব বাজে, এমন সময় আমি এ থানায় যোগ দিই। স্থানীয় ও যৌথ বাহিনীর সহায়তায় এখন পরিবেশ আগের চেয়ে অনুকূলে। এ বিষয়ে আমি ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে পরামর্শও চেয়েছি। সীমিত জনবল নিয়েও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। অন্তত অস্ত্রের মড়হাটা এখন আর নেই। যৌথ বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ঠিক করে ফেলেছে। মুঠোফোন ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো এখনো রয়েছে। তবে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। এলাকাবাসীও স্বস্তি বোধ করছেন।
শুধু মোহাম্মদপুরে নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটতে থাকে। এসব ঘটনায় ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে অথবা কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটান। গত ১৮ অক্টোবর উত্তরা এলাকার বাসায় ঢুকে মমতাজ শাহানারাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১৫ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কদমতলীর মেরাজনগরে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে খুন করে কাঁচামাল বিক্রেতা হাশেমকে। একই দিন ভোরে হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেলের পাশে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারীরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক সাদেকিনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় বেড়িবাঁধে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দিনমজুর আলমগীর ব্যাপারী। ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মুস্তাকিম আলিফ নামের এক তরুণ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালীতে রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা।
ডিএমপিতে যত মামলা
ডিএমপি থেকে যে মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিএমপিতে জানুয়ারিতে ডাকাতির একটি ও ছিনতাইয়ের ২৫টি মামলা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে দুই ডাকাতি ও ২৬ ছিনতাইয়ের মামলা, মার্চে একটি ডাকাতি ও ২৮ ছিনতাইয়ের মামলা, এপ্রিলে তিনটি ডাকাতি ও ১৫ ছিনতাইয়ের মামলা, মে’তে দুটি ডাকাতি ও ১৯ ছিনতাইয়ের মামলা, জুনে তিনটি ডাকাতি ও ১৬ ছিনতাইয়ের মামলা, জুলাইতে তিনটি ডাকাতি ও ১৫ ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা, আগস্টে চারটি করে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা, সেপ্টেম্বরে পাঁচটি ডাকাতি ও ১৪টি ছিনতাইয়ের মামলা ও অক্টোবরে পাঁচটি ডাকাতি ও ২১ ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়েছে। অর্থাৎ চলতি বছরের ১০ মাসে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় মোট ২৯ ডাকাতির ও ১৮৩ ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে।
মামলার এ পরিসংখ্যান নিয়ে ডিএমপি সদর দপ্তরের এক ঊর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছিনতাইকারী ও ডাকাতের অনেক ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। সে অনুপাতে পুলিশি তৎপরতা কম দেখা গেছে। কারণ, কিছুদিন আগ পর্যন্ত পুলিশ অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় ছিল। পারতপক্ষে থানার বাইরে যেতে না। ফলে, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যায়। আবার পুলিশ খানিকটা নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে মামলাও নিতে চাইতো না কিছুদিন আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঘটনা ঘটেছে, মামলা হয়েছে তার অনেক কম।
থানা থেকে পুলিশের মোটরসাইকেল চুরি
রাজধানী ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে চলেছে। থানা থেকেও ঘটছে চুরির ঘটনা। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানা থেকে তিন পুলিশ সদস্যের তিনটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর দিনগত রাতে চুরির এ ঘটনা ঘটে। সেদিন রাত পৌনে ৩টার দিকে ভেড়ামারা থানার ভেতরের গ্যারেজ থেকে তিনটি মোটরসাইকেল চুরি করে নিয়ে যায় চোরচক্র।
থানায় কর্মরত পুলিশের এস আই আলামিন হোসেন, কনস্টেবল মাসুদ ও সোহেল রানা থানার ভেতরের গ্যারেজে মোটরসাইকেলগুলো রেখেছিলেন। ভোরে গ্যারেজে গিয়ে দেখতে পান সেগুলো নেই। চোরচক্রের সদস্যরা মোটরসাইকেলের লক ভেঙে সেগুলো নিয়ে গেছে।