চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আপসহীন খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া। ডাক নাম পুতুল। গৃহিনী থেকে দেশের প্রয়োজনে শুরু হয় রাজনৈতিক জীবন। এই পথ পাড়ি দিতে পদেপদে স্বাক্ষী হয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। কঠিন সময়েও দেশের স্বার্থে থেকেছেন আপসহীন। বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তে সফলতার সঙ্গে চালিয়েছেন দেশ। যে দেশে তারই স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বনামধন্য সেনানায়ক, রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রক্তাক্ত সেনা-অভ্যুত্থানে নিহত হলে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া হাল ধরেন বিএনপির। গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠেন একজন রাজনীতিবিদ। দীর্ঘদিন শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন ৭৯ বছর বয়সী বিএনপি প্রধান। বিশেষ করে ২০১৮ সালে দুদকের মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর পরিস্থিতির অবনতি হয় আশঙ্কাজনক হারে। দফায় দফায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক পর্যায়ে ২০২২ সালের জুন মাসে তাঁর হার্টে বেশ কয়েকটি ব্লক ধরা পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ একটিতে রিং পরানো হয়। এর ঠিক দুবছর পর তার হৃদযন্ত্রে বসানো হয় স্থায়ী পেসমেকার। এ ছাড়া লিভার সিরোসিসের জন্য টিপস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতার শুরু থেকেই বাইরে নিয়ে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড বারবার পরামর্শ দিলেও অনুমতি দেয়নি পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। গেল বছর ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে পাল্টে যায় পরিস্থিতি, অনুমতি মেলে বিদেশ যাওয়ার।
এরপর আজ মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে ‘লন্ডন ক্লিনিক’ এ ভর্তি হবেন তিনি। যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি (এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে জ্বালানি নেওয়া) থাকবে বলে জানিয়েছেন তার উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী।
এবার চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ছাড়াও খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হবেন ১৬ জন। এর আগে চিকিৎসার জন্য সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই লন্ডন যান খালেদা জিয়া। তিন মাসের বেশি সময় চিকিৎসার পর ১৮ অক্টোবর লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন তিনি। সেদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাখো নেতাকর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হন খালেদা জিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ বলেন, যদি আমরা ওখানে (লন্ডন ক্লিনিক) সুপারিশ করেন যে, ইয়েস সি নিডস...তাদের এখানে নাই, জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপিটাল নিয়ে যেতে হবে…তখন হয়ত যাওয়ার একটা প্রশ্ন আসে।
খালেদা জিয়ার স্কুল জীবন ও মুক্তিযুদ্ধের শুরু
১৯৪৫ সালের পনেরই আগস্ট জলপাইগুড়ি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ভাইয়েরা সবার ছোট। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। খালেদা জিয়ার বিদ্যালয় জীবন শুরু হয় দিনাজপুরে মিশন স্কুলে। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে বিয়ে হয়। ডিএফআই এর কর্মকর্তা হিসেবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। সেখানে করাচীতে ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে স্বামীর কর্মস্থলে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৬ মে থেকে ২৭ জুন নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় থাকেন ১৭ জুন পর্যন্ত। ২ জুলাই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সিদ্ধেশ্বরী এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে দু’ছেলেসহ খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ঢাকা সেনানিবাসে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান।
আপসহীন নেত্রীত্বে রাজপথ থেকে ক্ষমতার মসনদ
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ নেন খালেদা জিয়া। পরে দলের প্রধান হিসেবে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে কাটিয়ে দেন ৯ বছর। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর সাধারণ নির্বাচনে চমকপ্রদ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়েন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ‘আপোসহীন নেত্রী’র খেতাব পাওয়া খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নানা চাড়াই-উত্তরাই পার করেছেন। তবে তাঁর আপোষহীন নেতৃত্ব দেশে-বিদেশে রাজনৈতিকদের কাছে সমাদৃত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এনটিভি অনলাইকে বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে কথা বলেন, ওই কথা অনুযায়ী চলেন বলেই তিনি আপোসহীন নেত্রী।’
ঐক্যজোট গঠন
১৯৮৩ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এরপর এই জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল যুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে ১৫ দলীয় জোট। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চলে পাঁচ দফা আন্দোলন। কিন্তু সে বছরের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জোট ভেঙে যায়। ৮ দল নির্বাচনে যায় আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দল ও পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট নির্বাচন প্রত্যাখান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। দীর্ঘ আট বছরের সংগ্রাম শেষে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় খালেদা জিয়ার দল। সেই নির্বাচনে পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে সবকটিতেই জয়লাভ করেন বেগম জিয়া।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফের সরকার গঠন করেন খালেদা জিয়া। যদিও বিরোধীদলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে ১৫ দিন পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ান তিনি। সপ্তম জাতীয় সংসদে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৯৯৮ সালে বিএনপি জামাতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর নির্বাচনে চারদলীয় জোট জয় লাভ করে সরকার গঠন করেন।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর মেয়াদ শেষ হয়। এরপর এক-এগারোর সেনা সরকারের সময় গ্রেপ্তার হন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে ছেলেসহ গ্রেপ্তার হন। পরে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। যদিও আপসহীন নেত্রী দেশের প্রশ্নে ২০১৪ সালের পাতানো নির্বাচন বর্জন করেন। এরপর ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিলেও পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তারপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন গড়ে তোলে তার দল। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ‘ডামি নির্বাচন’-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে ফুঁসে থাকা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হয়। জনতার মধ্যে বয়ে যায় আনন্দের সুবাতাস।
সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে এক যুগ পর ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কারামুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঘরের বাইরে বের হন তিনি। তাঁকে দেখতে অতিথিদের অনেকেই সেখানে ভিড় করেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন তিনি। সেখানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাদের পাশাপাশি চেয়ারে বসে কথা বলতে ও হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে।
খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড
খালেদা জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগীতা সংস্থা-সার্ক এর দুবার চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় নারী সরকার প্রধান।