খেলাপি ঋণের ধকল কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নিয়ম কতটা কার্যকর
খেলাপি ঋণের কারণে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকে সৃষ্ট মারাত্মক তারল্য সংকট ও দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা সামাল দিতে ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা অর্থ, অর্থাৎ প্রভিশনিংয়ে আন্তর্জাতিক ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টি স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস-৯) মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিল্পগোষ্ঠী এস আলম-সংশ্লিষ্ট ছয় শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক, শিকদার গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট ন্যাশনাল ব্যাংক এবং বেক্সিমকো-এস আলমের ঋণখেলাপির ফাঁদে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক তারল্য সংকটে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশের দশ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মোট প্রভিশন ঘাটতির ৬৫ শতাংশের ওপর শুধু জনতা ও ন্যাশনাল ব্যাংকে।
তারল্য সংকটের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট প্রভিশন না থাকায় এসব ব্যাংক রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
গত নভেম্বরে দুর্বল ব্যাংকগুলো বাঁচাতে ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তানুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ব্যবস্থা পুরোপুরি আইএফআরএস-৯ এর এক্সপেক্টেড ক্রেডিট লস (ইসিএল) মডেল অনুযায়ী সাজানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড (আইএএসবি) ২০১৪ সালের জুলাই মাসে আইএফআরএস-৯ এর আওতায় বর্তমান ইসিএল মডেল চালু করে।
গতানুগতিক রীতি অনুযায়ী, ঋণের খেলাপি না হওয়া পর্যন্ত কিংবা প্রদেয় ঋণ শ্রেণিকরণের আগ পর্যন্ত সেটিকে চিহ্নিত করা ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন। এ ক্ষেত্রে ইসিএল মডেলে শুরু থেকেই প্রদেয় ঋণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব। এই মডেলের আওতায় একটি ঋণের অতীত ইতিহাস, বর্তমান পারফরম্যান্স ও ভবিষ্যতে ঋণের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এতে করে হঠাৎ খেলাপি হওয়ার মতো ঘটনা বা ব্যাংকগুলো চাইলেই খেলাপির তথ্য লুকানোর মতো কাজ করতে পারে না।
ব্যাংকিং খাতে ইসিএল মডেলের রোডম্যাপ
সম্প্রতি ঋণ প্রভিশনে ইসিএল মডেল বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা দিয়ে দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এতদিন ঋণের প্রভিশন রাখার ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক খরচ ও ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে অ্যাকাউন্টিং মডেল মানা হলেও ২০২৭ সালের মধ্যে এ মডেল থেকে বের হয়ে ইসিএল মডেল মানা হবে।
এই মডেলের মাধ্যমে কোনো ঋণ পুরোপুরি খেলাপি হওয়ার আগেই এর প্রভিশন নিশ্চিত থাকবে। এতে করে কোনো কারণে ঋণখেলাপি হলেও ব্যাংকগুলোকে বড় রকমের তারল্য সংকটের মুখোমুখি হতে হবে না। এমনকি ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে আসবে।
আগামী দুই বছরের মধ্যে তিন ধাপে আইএফআরএস-৯ মডেল দেশের সবকটি ব্যাংকের প্রভিশন প্রক্রিয়ায় কার্যকর করার রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রকাশিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা প্রধান নির্বাহীকে নতুন মডেল বাস্তবায়নে নিজ নিজ ব্যাংকে আলাদা ওয়ার্কিং টিম গঠন করতে হবে। এই ওয়ার্কিং টিমে ব্যাংকের অন্যান্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রধান রিস্ক অফিসার (সিআরও) এবং প্রধান ফাইনান্সিয়াল অফিসারের (সিএফও) অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব টিমকে কর্মবণ্টন ও সময় বেঁধে দিয়ে ব্যাংকগুলোকে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনসহ চলতি বছরের ১৫ এপ্রিলের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবগত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের নির্দিষ্ট ওয়ার্কিং টিম চলতি বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে নতুন মডেলে ব্যাংকের প্রভিশন কার্যক্রম স্থানন্তর করতে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের নির্ধারিত টিম চলতি বছর জুলাই ও অক্টোবরে দুই মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংককে নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করবে।
বিশেষ করে ইসিএল মডেলের অটোমেশন বাস্তবায়নে ব্যাংকের আইটি খাতকে ঢেলে সাজানোর ওপর আলাদাভাবে জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি প্রয়োজন হলে ব্যাংকগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমেও অটোমেশন করতে পারবে। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে নিজেদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সবশেষ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসিএল মডেলের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন প্রকাশ করবে এবং সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর এতদিনের কর্মযজ্ঞ নির্ধারিত কাঠামোতে সাজিয়ে ওই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রস্তুতি ও সক্ষমতার সর্বশেষ প্রতিবেদন জমা দেবে।
এরপর আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ২৫ শতাংশ ঋণের পোর্টফোলিও অটোমেশনের মাধ্যমে ইসিএল মডেলেও আওতাভুক্ত করা হবে। ধাপে ধাপে ২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে এ পোর্টফোলিও ৭৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে এবং ২০২৭ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংকখাতে ঋণের প্রভিশন ব্যবস্থা শতভাগ আইএফআরএস-৯ অনুমোদিত ইসিএল মডেলের আওতাভুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয়তা
ঋণ প্রভিশনের ক্ষেত্রে ইসিএল মডেল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুফল নিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা খাতসংশ্লিষ্টদের। বিগত সময়ে খেলাপি হবে জেনেও ঋণ দেওয়া এবং খেলাপি হওয়ার পরেও তথ্য গোপনের মতো ঘটনা আগামীতে যেন না ঘটে, সেজন্য এ মডেলের বাস্তবায়ন ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ইউএনবিকে বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে প্রায় এমন একটি মডেল দেশের ব্যাংক খাতে প্রয়োগ করা হয়েছিল। মডেলটি বাস্তবায়নের পর দেখা গেল—যেসব ব্যাংক নিজেদের শক্তিশালী দাবি করে, তাদের অনেকের অবস্থাই নাজুক। ব্যাংকগুলো নিজেদের নাজুক অবস্থা লুকিয়ে রেখেছিল, যা এ মডেলের মাধ্যমে তখন প্রকাশিত হয়।’
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন একটি মডেলের বাস্তবায়ন ভালো একটি উদ্যোগ। তবে শুধু এই মডেল দিয়ে খেলাপি ঋণ বন্ধ করা যাবে না। বিগত সময়ের বেশিরভাগ খেলাপি ঋণের পেছনে সুশাসনের অভাব সরাসরি জড়িত ছিল।’
তাই আগামী দিনে এমন একটি মডেল কার্যকর করতে ব্যাংকখাতে সুশাসন নিশ্চিতের ওপর জোর দেন আবদুল মান্নান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘প্রথমত এই মডেলটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, অন্যদিকে এই মডেলের প্রতিটি নথি যুক্ত হবে অটোমেশনের মাধ্যমে। এখানে তথ্য গোপন বা ম্যানিপুলেশনের (অপব্যবহার) কোনো সুযোগ থাকবে না। এতে করে দেশের প্রতিটি ব্যাংকের বাস্তবিক অবস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পরিষ্কার থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।’
দুই বছরের মধ্যে এই মডেল বাস্তবায়ন করতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রযুক্তি খাতকে বর্তমানের তুলনায় আরও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সক্ষমতা যাচাইয়ের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আলাদা জোর দেয়া আবশ্যক বলেও মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।