জুলাই অভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব : এইচআরডব্লিউ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশকে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশ সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্বই দিয়েছিল।
গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) এইচআরডব্লিউর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ইলেন পিয়ারসনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটি ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘বর্ষা-বিপ্লব পরবর্তী: বাংলাদেশের নিরাপত্তা খাতের স্থায়ী সংস্কারের রোডম্যাপ’ এ শীর্ষক প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, আন্দোলনের সময় অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নির্দেশ তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে পেয়েছেন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্দোলন চলাকালে পুলিশ কর্মকর্তারা প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের জন্য বারবার সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন নির্দেশ পেয়েছিলেন।
এইচআরডব্লিউর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, ওই অস্থিরতার সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের থেকে বেশি নির্ধারিত হচ্ছিল রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা।’
অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, ‘আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এমনকি আশপাশের বাড়ি থেকে যারা আন্দোলন দেখছিল, তাদের ওপরও গুলি চালাতে। মূল উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া যেন তারা দেখার চেষ্টা না করে।’
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, “সিনিয়র কর্মকর্তারা আমাদের যারা ‘অরাজকতা’ সৃষ্টি করছে, তাদের কাউকে ছাড় না দেওয়ার এবং কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন। সরাসরি ‘গুলি চালাও’ না বললেও নির্দেশ ছিল স্পষ্ট; সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করো, যা প্রয়োজন মনে করো, তা-ই করো।”
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তারা সরাসরি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের ভিডিও গেমের মতো গুলি চালানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে এ নির্দেশ দেন, যিনি পরে ডেপুটি কমিশনারদের নির্দেশ দেন।’
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে এই নির্দেশের ধারাক্রম বাংলাদেশের পুলিশ কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আগস্টে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আন্দোলনকারীদের সহিংসতা ঠেকানো প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলছিলেন, ‘গুলি করি, মরে একটা। আহত হয় একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এইডা হইল স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের।’
ছাত্র আন্দোলনকারীদের অপহরণ ও নির্যাতন
২৬ জুলাই, ছয়জন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ঢাকার একটি হাসপাতালে আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিতে গেলে সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের অপহরণ করে। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলায় তারা আহত হয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের এক সপ্তাহ ধরে গোপন স্থানে আটক রাখা হয় এবং একটি ভিডিও বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়, যেখানে তারা আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দেন। তবে ১ আগস্ট তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান।
আন্দোলনের পর সহিংসতা ও পুলিশের ভূমিকা
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পর পুলিশ বেশ কিছু সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়। এর মধ্যে ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভে হতাহতদের বহনকারী গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, হাতকড়া পরা অবস্থায় অন্তত একজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৫৫ বছর বয়সী রাজিয়া বেগম বলেন, ‘আমার জীবনে আমি প্রথমবার নিরপরাধ মানুষকে এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে দেখলাম। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপরও গুলি চালায়। রাস্তা তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।’
রাজিয়া বেগম আরও যোগ করেন, ‘মানুষের পায়ে নয়, সরাসরি শরীরে গুলি করা হচ্ছিল।’