জুলাই অভ্যুত্থান : যেসব কারণে ফুঁসে উঠেছিল মানুষ
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/05/bangladesh.jpg)
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন এক ঘটনা ঘটে। একটানা ১৬ বছর কঠোরভাবে বিরোধী দলকে দমন করে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে গোপনে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়।
অথচ মাত্র দুই মাস আগে ২০২৪ সালের ৫ জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন হয়তো কেউ ধারণাই করতে পারেননি যে, এত দ্রুত শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হবে।
মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মাথায় সেই বিক্ষোভের জেরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফেলে শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
আন্দোলন শুরু হয়েছিল ছাত্রদের কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে এই ‘গণবিদ্রোহে’ অংশ নেয় পুরো দেশের সব বয়সের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু কেন ফুঁসে ওঠেছিল শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের সাধারণ মানুষ?
মানুষের মনে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ
শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের মনে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ যেন একটি বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি। বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
ফলে যখনই সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়ানা না করে সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ পথে নেমে এসেছিলেন।
ভোট ও মতপ্রকাশের অধিকার
আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে ‘একনায়কতান্ত্রিক’ ও ‘স্বৈরাচারী’ সরকারে পরিণত হয়েছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম ঘটে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ‘রাতের নির্বাচন’ বলেও অনেকে বর্ণনা করেন।
এমনকি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি ও একতরফা হয় এবং আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করে। ফলে গত ১৬ বছরে মানুষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার কোনো অধিকার পায়নি।
এই দীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে শক্ত হাতে দমন করার পাশাপাশি বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ শত শত নেতাকর্মীকে গুম করা হয়, মামলা বা সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়। অনেক নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়।
পুলিশের অনুমতি ছাড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সভা সমাবেশও করতে দেওয়া হয়নি।
ভয়ের সংষ্কৃতি ও মানবাধিকার হরণ
স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির ব্যাপক অভিযোগ করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
আওয়ামী শাসনামলে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিরুদ্ধ মত দমন করা হয় কঠোর হাতে। দেশের অনেক বিরোধী গণমাধ্যম হয় বন্ধ করে দেওয়া হয় অথবা দখল নেওয়া হয় বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়।
শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা ও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে।
সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার জের ধরে অনেককে মাসের পর মাস ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়।
সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে ‘মাফিয়া স্টেটে’ পরিণত করা হয়। আর এজন্য সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী, এমনকি বিচার বিভাগকেও ব্যবহার করা হয়।
বছরের পর বছর বিরোধীদের গুম বা আটক রাখা হয়েছে। অনেককে আট বছরের বেশি সময় ধরে কোনো অভিযোগ ছাড়াই ‘আয়নাঘরে’ আটকে রাখা হয়।
এমন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি ও ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতেই স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে নামে ছাত্র-জনতা।
আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর দল
টানা ক্ষমতায় থেকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলটি হয়ে ওঠে পুরোপুরি প্রশাসন ও আমলানির্ভর।
প্রশাসন ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যাক্কারজনকভাবে দলীয়করণ করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দরজা বন্ধ হয়ে আসে। যোগ্যতার চেয়ে দল ও স্বজনপ্রীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে। সাংবাদিকসহ পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনেও ব্যাপক দলীয়করণ করা হয়।
দেশের সর্বত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি ও পাচারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করে দলটির নেতাকর্মীরা।
পাচার, দুর্নীতি ও বেগমপাড়া
আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠে। এমনকি দলটির ছোট ছোট নেতারাও বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) হিসেবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেই হিসেবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় ‘বেগমপাড়া’ গড়ে তোলার খবর সবার মুখে মুখে। দলটির অনেক নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ারও অভিযোগ আছে।
সরকারি অফিসে ঘুষ লেনদেন স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। সরকারি চতুর্থ শ্রেণির চাকরি পেতেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো।
অর্থনীতির ‘বারো’টা বাজিয়ে ফেলা
রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দিনে দিনে কঠিন হয়ে ওঠে।
রিজার্ভের ঘাটতি, ব্যাংকিংখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
দুর্নীতি-ঘুষ স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ছোট ব্যবসায়ী-হকার থেকে শুরু করে সেবা নিতে যাওয়া প্রতিটি মানুষের ঘুষ দিতে বাধ্য হতো।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বৈরাচারী সরকার।
ভারতের সঙ্গে একের পর এক অসম চুক্তি করা হয়, যেগুলোতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক বেশি সুবিধা পেতো।
প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারেননি শেখ হাসিনা
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন আলোচনা বা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা না করে সরকার গুলি-গ্রেপ্তারের মতো বলপ্রয়োগের পথে যায়।
শেখ হাসিনা মন্তব্য করে বসেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এর পরপরই শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে সড়কে নেমে আসে এবং ‘তুমি কে, আমি কে- রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ।
আওয়ামী লীগ আলোচনার আগ্রহী না হয়ে আগের মতো শক্ত হাতে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে।
প্রথমে নিজেদের ছাত্র বাহিনী ছাত্রলীগকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের দিয়ে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ।
বেপরোয়া গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। পরিস্থিতি সামলাতে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনার সরকার।
শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে ধরে এনে কারাগারে পাঠানো হয়। এমনকি রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনার পুলিশের গুলি করার ভিডিও থাকার পরও শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপানো হয়।
পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী বন্দুকধারীদের গুলি করার ছবি ও ভিডিও থাকার পরও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং নেতারা একের পর এক মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়েও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয় আওয়ামী সরকার।
স্বৈরাচারী সরকারের একের পর এক অবৈধ কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি, শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
যখন সরকার আলোচনার জন্য রাজি হয়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন তখন জনমানুষের ক্ষোভের আন্দোলনে পরিণত হয়।