দৃষ্টিহীন প্রথম শিক্ষার্থীই এখন তার বিদ্যাপীঠের সরকারি রিসোর্স শিক্ষক

দৃষ্টিশক্তির মতো প্রতিবন্ধকতা জয় করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন এন্ড রিসার্চ বিভাগ থেকে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করছেন। তাও আবার নিজে যে প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছেন সেখানেই।
ব্রেইল ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে পড়াশোনা করে নিজে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে, সরকারি চাকরির পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন লামনিরহাটের নাজমুল হক।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপটিবাড়ি বাজারে অবস্থিত কেন্দ্রে থেকে শিক্ষাগ্রহণ শেষে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এখন অনেকেই। তবে নাজমুল হক নিজে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সেই জয়ের মিছিলে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে সাথে নিয়েছেন। শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন তার মত দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে। ৩৫ বছর বয়সী মো. নাজমুল হক লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের তালুক হরিদাস গ্রামের, মো. মজিবুর রহমানের ছেলে।
বর্তমানে নাজমুল হক সমাজসেবা অধিদপ্তর সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম, সাপটিবাড়ি, আদিতমারী, লালমনিরহাটের রিসোর্স শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
এক ছেলে আর এক মেয়ের বাবা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাজমুল হক এখন সুখে আছেন। তবে শুরুটা একদম ভালো ছিল না তার। নাজমুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “আমার চাকরিতে যোগদানের আগের দিনও আমার বাবা রিকশা চালিয়েছে।” নাজমুল হক বলেন, “শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়, তার প্রতিবন্ধকতা ছিলো অনেক।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়ন করতে বাংলাদেশ সরকার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে শিক্ষার সুযোগ পায় এবং তুলনামূলকভাবে ব্যয় বহুল প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচির পরিবর্তে স্থানীয় বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পড়াশুনা করতে পারে এবং নিজস্ব পরিবেশ ও অবস্থার সাথে খাপ খেয়ে চলাফেরা করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত করে ১৯৭৪ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
প্রতিটি কার্যক্রমে একজন করে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘রিসোর্স শিক্ষক’এর তত্ত্বাবধানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমে এখানে ১০ জন শিক্ষার্থীর আসন রয়েছে। ১০ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এখানে থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করেন পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই শিক্ষা কার্যক্রমটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিনা খরচে থাকা-খাওয়াসহ লেখাপড়া নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ছাড়াও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা, ধর্মীয় শিক্ষাসহ বিভিন্নভাবে দক্ষ করে তুলছে এই কার্যক্রম।
নানা প্রতিকূলতা জয় করা নাজমুল হক চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তে থাকা অবস্থায় হঠাৎই দৃষ্টিশক্তি হারান। অনেক চিকিৎসার পড়েও চোখের আলো ফিরে না পেয়ে হতাশায় ভেঙে পড়ে নাজমুল। পড়ে ১৯৯৬ সালে সরকারের এ কার্যক্রম লালমনিরহাটের আদিতমারীতে বাস্তবায়িত হলে সেই কেন্দ্রের প্রথম শিক্ষার্থী হওয়ার সৌভাগ্য হয় নাজমুল হকের। বদলাতে থাকে নাজমুলের জীবন। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখান শিক্ষক। তাই ব্রেইল বইয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে নেন তিনি। অদম্য মনোবল আর নিরলস প্রচেষ্টায় একে একে অর্জন করেছেন নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ স্নাতকোত্তরের মতো ডিগ্রি। পরে দৃষ্টি শক্তিহীনদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে নিজে যেখানে থেকে পড়াশোনা করেছেন। এখন তিনি সেখানেই করছেন শিক্ষকতা।
নাজমুলের সহকর্মী শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বলেন, স্যার নিয়মিত অফিস করেন। তিনি প্রতিদিন রিকশায় করে আসেন। কারো সহায়তা ছাড়াই তিনি চলাচল করেন। বাইরে চলাচলের জন্য তিনি বিশেষ সাদাছড়ি ব্যবহার করেন। অনেক ভালো মনের হাস্যোজ্জ্বল মানুষ নাজমুল স্যার।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপটিবাড়ি কেন্দ্রের শিক্ষার্থী শাহাদাৎ হোসেন সূর্য বলেন, “আমি এখানে ১০ বছর ধরে আছি, এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এখানকার সবাই অনেক ভালো। আমরা একটি পরিবারের মতো। সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও আমাদের নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমি নজরুল স্যারের মতো ভালো মানুষ হতে চাই।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও নাজমুল সমাজের জন্য যে কাজ করে যাচ্ছেন তা প্রশংসার দাবিদার বলছেন স্থানীয়রা। এমন সহকর্মীর জন্য গর্ব করে ভূয়সী প্রশংসা করেন লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতিয়ার রহমান। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “নাজমুল ১৯৯৬ সালে যখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপটিবাড়ি কেন্দ্র চালু হয়, সেখানকার প্রথম নিবাসী নাজমুল। তার অদম্য চেষ্টায় আজ তিনি সফল। আসলে অন্ধত্ব কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।”