আন্দোলনকারীদের ফাঁসি ও মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে হামলা, গুলিবর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা। শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস, ঢাবির সাবেক উপাচার্য (ভিসি) মাকসুদ কামাল ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ফোনালাপের অডিও রেকর্ড আদালতে উপস্থাপন করে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামিদের কথোপকথনের অডিওতে শোনা যায়—আন্দোলনকারীদের অবস্থান ড্রোনের মাধ্যমে নির্ণয় করা, হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং ও গুলি বর্ষণ করা, লেথাল উইপন ব্যবহার করা, আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকা করে পাকড়াও করা, রাজাকার ট্যাগ দিয়ে তাদের ফাঁসি দেওয়া ও মেরে ফেলা, সেনাবাহিনী নামিয়ে দমন করা, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা, আগুন লাগানো, জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোসহ আরও অন্যান্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।’
আজ বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ জবানবন্দি দেন প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা। এ নিয়ে এ মামলায় ৫১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
জবানবন্দিতে প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমার নাম তানভীর হাসান জোহা। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর এবং একইসঙ্গে এই মামলার বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা। তদন্তকালে আমি বিটিআরসি, এনটিএমসি, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর হতে বিভিন্ন অডিও ক্লিপ, ভিডিও ফুটেজ, সিডিআর, আইপিডিআর, সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয় বিধিমোতাবেক বিভিন্ন আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করি।’
‘এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের সিডিআর এনটিএমসির (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) সহকারী ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশিক্ষক সাদি মোহাম্মদ রিফাতের উপস্থাপন মতে বিধিমোতাবেক জব্দ করি’, যোগ করেন তানভীর হাসান জোহা।
ট্রাইব্যুনালে তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘অতঃপর সংগৃহীত অডিও ক্লিপগুলোর পর্যালোচনা ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর হতে শুরু করি। পর্যালোচনাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফজলে নূর তাপসের একটি ফোনালাপ, যা একটি ডিভিডিতে ধারণপূর্বক তাদের প্রামাণ্য কণ্ঠস্বর সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য ঢাকা সিআইডির ফরেনসিক শাখায় পাঠাই। এই ফোনালাপের শুরুতে কল প্রদানকারীসহ অপর একজন ব্যক্তির কথোপকথন শোনা যায়। শেখ হাসিনার ওই ফোনালাপের শেষে অন্য এক পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।’
তানভীর হাসান জোহা আরও বলেন, ‘সিআইডি ফরেনসিক বিভাগের পরিদর্শক রুকনুজ্জামান চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি উক্ত ফোনালাপ পরীক্ষান্তে নিশ্চিত করেন, অডিও ক্লিপে ফোনালাপে থাকা একজন শেখ হাসিনা ও অপরজন ফজলে নূর তাপস। উক্ত মতামত আমি তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কের নিকট হস্তান্তর করি। উক্ত অডিওগুলো পর্যালোচনাকালে আমি শেখ হাসিনা ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামালের ফোনালাপ শনাক্তপূর্বক একটি সিডি ডিস্কে সংরক্ষণ করে তা তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কের কাছে হস্তান্তর করি। তাদের দুজনের প্রামাণ্য কণ্ঠস্বরসহ উহার একটি কপি পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাই। পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহেদ জুবায়ের লরেন্স পরীক্ষান্তে রিপোর্টসহ মতামত প্রদান করেন।’
জবানবন্দিতে তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘মতামতে তিনি (এসআই শাহেদ জুবায়ের লরেন্স) উল্লেখ করেন, উক্ত ফোনালাপটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এস এম মাকসুদ কামালের। উক্ত মতামত আমি তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কের কাছে হস্তান্তর করি। উক্ত অডিওগুলো পর্যালোচনার সময় হাসানুল হক ইনু ও শেখ হাসিনার তিনটি ফোনালাপ শনাক্তপূর্বক একটি ডিভিডি ডিস্কে সংরক্ষণ করে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কের কাছে হস্তান্তর করি। এসআই শাহেদ জুবায়ের লরেন্স পরীক্ষান্তে উক্ত ফোনালাপগুলো শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর কণ্ঠস্বর মর্মে মতামত প্রদান করেন।’
তানভীর হাসান জোহা আরও বলেন, ‘উক্ত ফোনালাপগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনা লেথাল উইপন ব্যবহার করে সরাসরি গুলির নির্দেশ দিয়েছেন এবং ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয় পূর্বক হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করা, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করাসহ আন্দোলনকারীদের রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ফাঁসি দেওয়ার কথা বলেছেন। তারা উক্ত ফোনালাপে ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের দমন করতে বলেছেন।’
প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘উক্ত পাঁচটি অডিও কথোপকথন সম্বলিত তিনটি সিডি অদ্য ট্রাইব্যুনালে দাখিল করলাম। ইহা শেখ হাসিনা ও ফজলে নূর তাপসের কথোপকথন সম্বলিত সিডি (বস্তু প্রদর্শনী-২৯)। ইহা শেখ হাসিনা ও এ এস এম মাকসুদ কামালের কথোপকথন সম্বলিত সিডি (বস্তু প্রদর্শনী-৩০)। ইহা শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর কথোপকথন সম্বলিত সিডি (বস্তু প্রদর্শনী-৩১)।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি, গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।