নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি : প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশে আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। তিনি উল্লেখ করেন, ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।
আজ শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গত বছর এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমরা এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি, তা বলব। পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনের নিবাস বাংলাদেশে। শুধু সে কারণে অথবা ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে বলে আমাদের ইতিহাস জানার দরকার তা নয়, বরং এ কারণে বাংলাদেশের বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ, তার সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার ওপর আস্থা তৈরি করবে। এটি বিশ্বের সব দেশের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে। সংকট যত গভীর হোক, যত অসম্ভবই মনে হোক, কখনই তাদের উত্তরণের পথ হারিয়ে ফেলে না।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু যে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বিশাল আত্মত্যাগ করেছিলাম তা গত পাঁচ দশকে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বারবার আমাদের ছেলে-মেয়েদের নেতৃত্বে আমাদের জনগণকে অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করে সেই অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এ বছর আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালন করেছি। যে অভ্যুত্থানে আমাদের তরুণ সমাজ স্বৈরাচারকে পরাভূত করেছিল, যার ফলে আমরা বৈষম্যমুক্ত ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অভিযাত্রা নতুনভাবে শুরু করতে পেরেছি। সেই বৈষম্যমুক্ত ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে ও আমার সহকর্মীদের।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভেঙে পড়া রাষ্ট্র পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করা, কিন্তু আমরা বেছে নেই সেই কঠিন পথ--অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ। আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না। কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপকে ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না, কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকরা ভক্ষকে পরিণত হতে পারবে না। শাসন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার জন্য আমরা ১১টি প্রয়োজনীয় স্বাধীন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করি।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনা করে বিস্তারিতভাবে সংস্কার কার্যক্রমগুলো সুপারিশ করে। এ সংস্কার সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করি, যারা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনায় বসে। এ কমিশনের লক্ষ্য ছিল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি দল-মত নির্বিশেষে একটি টেকসই সামাজিক অঙ্গীকার তৈরি করা। আমাদের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ সফল হয়। আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে জুলাই ঘোষণার মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সবার আবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। অর্থাৎ, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। আপনারা জানেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, গত বছর দায়িত্ব গ্রহনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানাই। পতিত স্বৈরশাসক কর্তৃক সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতার চিত্র উদঘাটন করার জন্য। তারা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য যে সুপারিশমালা দিয়েছে তা আমরা আমাদের জাতীয় সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করেছি। গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই আমরা গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলাম। এখন এর বিধানগুলো জাতীয় ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এ বছর আমরা জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটকলে যোগ দিয়েছি এবং এর বাস্তবায়নে স্বাধীন প্রতিরোধমূলক জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কাজ করছি।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, নিবর্তনমূলক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মানবাধিকার রক্ষাকারী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা আমাদের দেশে তিন বছর মেয়াদে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের একটি মিশন পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছি, যা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাদের এসব পদক্ষেপ ও অঙ্গীকার জনগণের প্রত্যাশারই প্রতিফলন। এই প্রত্যাশা মূলত একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যাশা।
অধ্যাপক উইনূস বলেন, আমাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, টেকসই উন্নয়ন। বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, জবাবদিহিতা ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীন স্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির ওপরে চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনো কল্যাণও করে না। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা একে একে আবিষ্কার করি, দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কী ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা কী ভয়ানক, নাজুক ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। আমরা এর অবসান ঘটাচ্ছি, যেন আর কখনই উন্নয়নকে জনগণের সম্পদ আত্মসাতের অধিকার হিসেবে ব্যবহার করা না যায়। দেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মজবুত করতে আমরা সংস্কারমূলক কিছু কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কার হলো রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার। যেখানে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থাকে পৃথক করার জন্য আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থা, বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা সংস্কার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক কর সুবিধার বৈশ্বিক কাঠামো, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও দুর্নীতিবিরোধী সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অবৈধ দুর্নীতিলব্ধ অর্থ ও পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।