চুক্তিভিত্তিক সচিবদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, পদোন্নতির স্থবিরতায় নিয়মিত কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ অন্তত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বে আছেন চুক্তিভিত্তিক সচিবরা। এমনকি পদোন্নতির সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সাত সদস্যের মধ্যে চারজনই চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তা। এতে প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক আমলাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে, ক্ষোভ বেড়েছে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে।
জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে শুরু করে মুখ্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব— প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এখন পরিচালিত হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক সচিবদের হাতে।
প্রশাসনের পদোন্নতি, পদায়ন ও নিয়োগে প্রভাব পড়ছে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত। তবে তাদের অনেকেই প্রায় এক যুগ প্রশাসনের বাইরে থাকার পর ফের দায়িত্ব পেয়েছেন। ফলে প্রশাসনে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, স্থবিরতা ও নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ।
এ প্রসঙ্গে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক অনেক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলেন। তাদের কেউ কেউ দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেও অনেকে কাঙ্ক্ষিতভাবে কাজ করতে পারছেন না। সরকারের উচিত, যারা ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের চুক্তি বাতিল করা।’
আবদুল আউয়াল আরও বলেন, ‘চুক্তির কারণে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ব্যাহত হয়। এ কারণে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যোগ্য দেখে নতুনদের সুযোগ তৈরি করা। নিয়মিত পদোন্নতিসহ নিয়মিতদের মাধ্যমে প্রশাসনে গতি বৃদ্ধি করতে হবে।’
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক ২০জন কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব ও ৭১ জন কর্মকর্তা সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন : সচিবালয় থেকেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধের যাত্রা শুরু হলো : পরিবেশ উপদেষ্টা
তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহসানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোখলেস উর রহমান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদস, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা) সিদ্দিক জোবায়ের, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা) এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব পদমর্যাদা) ড. কাইয়ুম আরা বেগম, বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব পদমর্যাদা) এস এম মঈন উদ্দিন এবং মকসুমুল হাকিম চৌধুরীকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (সচিব পদমর্যাদা) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পদে। ড. মো. মাহফুজুল হককে পর্তুগালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব পদমর্যাদা) এবং বেগম শরিফা খানকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (সচিব পদমর্যাদা) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ সময় প্রশাসনের বাইরে থাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এসব সিনিয়র সচিব ও সচিব স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে মানিয়ে নিতে পারছেন না।
তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন প্রশাসনের বাইরে থাকা চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তারা এখনো পুরোনো ধাঁচে কাজ চালাচ্ছেন। তারা এখনো সেই ১৫ বছর আগে তাদের রেখে যাওয়া প্রচলিত নিয়মে প্রশাসন পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। এমনকি তারা নিজেদের ব্যাচ (বিসিএস ১৯৮২) ঘিরে বলয় তৈরি করেছেন, যাতে অন্য ব্যাচের যোগ্য কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে না পারেন।
প্রশাসনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা যায়, আওয়ামী স্বৈরশাসনের পতনের পরও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। এখনো দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে এসেছে।
জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর ডিসি নিয়োগে হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে। এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ওয়াশরুমে আটকে রাখার ঘটনাও প্রশাসনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
সর্বশেষ শিক্ষাসচিব ও জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে একটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা অতীতের সব রেওয়াজ ভেঙে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যা এখন আমলাপাড়ায় ‘ওপেন-সিক্রেট’।
এর মধ্যে ডিসি নিয়োগে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে। পরে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে গত ২১ সেপ্টেম্বর বদলি করে পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এর ২১ দিন পর এই পদে বদলি করা হয় চুক্তিতে থাকা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহছানুল হককে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দুই দশকে এক দিনের জন্যও সচিব ছাড়া থাকার নজির নেই। এর আগে প্রায় এক মাস খালি থাকার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।
এতে প্রশাসনে আস্থাহীনতা ও মনোবলহীনতা বেড়ে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে দক্ষ কর্মকর্তা সংকট প্রকট হচ্ছে— বিশেষ করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)