বাঁশের ভেলায় জীবন-জীবিকা
নদীতে ভাসছে সারি সারি বাঁশের ভেলা। খটখট শব্দে বাঁশের ভেলা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা। বান্দরবানের লামা উপজেলার মাতামুহুরী নদী। পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় বেড়ে উঠা বাঁশ এই মাতামুহুরী নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সারা দেশে। মাতামুহুরী নদীকে কেন্দ্র করে নদীর ঘাট সংলগ্ন এলাকায় সাপ্তাহে প্রতি শুক্রবার বাঁশের হাট বসে। যেখানে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ ব্যবসায়ীরা আসায় বেচাকেনা হয় লাখ লাখ টাকার বাঁশ।
লামার মাতামুহুরী নদীতে ঘুরে দেখা গেছে, লামামুখ মাতামুহুরী নদীর ঘাটে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাঁশের ভেলা। নদীপারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ক্রেতা ও বিক্রেতারা দরকষাকষিতে ব্যস্ত। শ্রমিকরা ব্যস্ত এলোমেলোভাবে ভেসে থাকা বাঁশের নতুন ভেলা বানাতে। লামামুখ নদীর ঘাট লামা খাল ও পোপা খালের সংযোগ স্থল। খালগুলো থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশের সারি। দেখে মনে হয় নদীর পানিতে থাকা বাঁশের ভেলায় ভাসছে পাহাড়ি জনপদের মানুষের জীবন ও জীবিকার সপ্ন।
মুলি, মিটিংগ্যা, ডলু, বরাক, বাজালি, নলি, কালিছড়ি, টেংরামূলি, বাড়িওয়ালা, ওরাহ, বাইজ্জাসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির বাঁশ বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ে হয়ে থাকে। এসব বাঁশ বিক্রির মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এসব বাঁশ সারা দেশের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহ হয়ে থাকে। যা থেকে লামা বন বিভাগ প্রতি বছর কয়েক লাখ টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে।
লামা বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে শুধু লামামুখ বন চৌকি থেকে লামা বন বিভাগ রাজস্ব আদায় করেছে ১০ লাখ ৭ হাজার ৪১০ টাকা। চলতি অর্থবছরে দুই মাসে লামা বন বিভাগ আদায় করেছে এক লাখ ৯২ হাজার ৫৪০ টাকা।
বন বিভাগের মতে বাঁশ অপ্রধান বনজ দ্রব্য। সরকার নির্ধারিত বাজালী, ছোটিয়া, নলি প্রতি হাজারে ৮০০ টাকা, কালিছড়ি প্রতি হাজারে এক হাজার টাকা, টেংরামূলি প্রতি হাজারে এক হাজার ২০০ টাকা, মূলি প্রতি হাজারে দুই হাজার ৮০০ টাকা, মিতিংগা ও ডলু প্রতি হাজারে তিন হাজার টাকা, বাড়িওয়ালা প্রতি হাজারে ১০ হাজার টাকা এবং ওরাহ প্রতি হাজারে তিন হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়। এ ছাড়া অপ্রধান বনজ দ্রব্যের ভ্যাট ১৫ শতাংশ হারে আদায় করা হয়।
প্রতি সপ্তাহে একবার বান্দরবানের লামায় মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন বাজার সংলগ্ন ঘাটে বাঁশ কিনতে আসে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ীরা। তারা সেই বাঁশ মাতামুহুরী নদীতে ভাসিয়ে অথবা সড়ক পথে সারা দেশে বাঁশ নিয়ে যায়।
কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে আগত বাঁশ ব্যবসায়ী আবদুল মোনাফ বলেন, পাহাড়ি এলাকার বাঁশ গুণে-মানে খুবই ভালো। লামা পাহাড়ি এলকা হওয়ায় এখানে সকল প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। আমার বাপ-দাদা এই বাঁশ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে আমিও বংশ পরম্পরায় এই ব্যবসার সঙ্গে আছি। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাঁশের চাহিদা কমা থাকায় এবং বন বিভাগের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের কারণে মন্দায় আছেন বাঁশ ব্যবসায়ীরা।
লামামুখ এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নুরু বলেন, আমাদের এলাকার বাঁশের চাহিদা সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে লামার বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বাঁশ সঠিক দাম দিয়ে কিনে থাকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাহিদা কমে গেলে বাঁশের সঠিক দাম পাওয়া যায় না। তা ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বাঁশের চাহিদা কমায় আগের মতো ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।
লামা সদর ইউনিয়নের মেহুলারচর এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এক সময় বাঁশের ব্যবসা খুবই লাভজনক ছিল। আমরা বাঁশ ব্যবসায়ীরা আগের মতো ভালো নেই। ব্যবসা আগের মতো হচ্ছে না। বাঁশ পরিবহণের সময় ঘাটে ঘাটে আমাদের বিভিন্ন চাঁদা দিতে হয়। সেই সাথে বন বিভাগের অতিরিক্ত রাজস্ব তো আছেই। সরকার রাজস্ব কিছুটা কমালে আমাদের জন্য সুবিধা হতো।
অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে লামা বন বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার এ. কে. এম. আলতাফ হোসেন বলেন, সরকারের নির্ধারিত রাজস্ব ছাড়া অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ নেই। বাঁশ ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার পাশাপাশি স্থানীয়দের বাঁশ চাষে উৎসাহ দিচ্ছে লামা বন বিভাগ।
বর্তমানে পাহাড়ে জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড় কেটে বিপুল মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করছে। অনেকে পাহাড়ে আগুন দিয়ে জঙ্গল পুড়িয়ে জুম চাষ করছে। এসব কারণে বাঁশের প্রাকৃতিক উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া পাহাড়ে বসবাসকারী শতশত দরিদ্র নারী পাহাড় থেকে বাঁশের কোড়ল (বাঁশের চারা) কেটে এনে বাজারে বিক্রি করছে। বিপুল মানুষ বাঁশ কোড়ল সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এটি কেটে ফেলায় বাঁশ উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে।
স্থানীয়রা মনে করছেন, পাহাড়ি এলাকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে ওঠা এখন সময়ের দাবি। তাহলে বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

আমিনুল খন্দকার, বান্দরবান (আলিকদম-লামা)