দিনমজুর পারভীনের হৃদয়-বিদারক বর্ণনায় কেঁদেছেন সবাই
‘আমার নয় বছর ও চার বছরের দুই ছেলে রয়েছে, আমি তাদের দেখি না। এ মুহূর্তে আমি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার অনাগত সন্তানকেও আমি দুই চোখ দিয়ে দেখতে পাব না।’ পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো দিনমজুর পারভীন এভাবেই আদালতে দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দিনমজুর পারভীনের সাক্ষ্য প্রদানকালে আদালতের ভেতরে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। নির্যাতনের বর্ণনা শুনে কেঁদেছেন বিচারপ্রার্থীরা, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আদালতে উপস্থিত সবাই।
আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত এই নারী বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী এলাকায় কুতুবখালীতে আমার বাসা। আমি একজন দিনমজুর। কখনো সবজি বিক্রি করি, কখনো বাজারে মাছ কাটি। যখন যেটা পাই, সেই কাজ করি। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই আমি সকাল ৯টায় যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনা দিয়ে জুরাইন যাই। সেখানে কাজ শেষে বিকেলে বাসায় ফেরার পথে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে যাত্রাবাড়ীর ফ্লাইওভারের নিচে এসে দেখি বহু মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছে। একটি ছেলেকে পুলিশ গুলি করেছে। তার বয়স আনুমানিক ১৮ বছর হবে। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। তার বুকে গুলি লেগেছে। তার আশপাশে গরু জবাইয়ের মতো রক্ত বের হচ্ছে। তার পরনে সাদা প্যান্ট ও সাদা গেঞ্জি ছিল। গলায় একটি আইডি কার্ড ছিল। তার অবস্থা দেখে আমার খুবই মায়া হয়। আমি ওই ছেলেকে ধরে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সে আমাকে ধরে আমার ঘাড়ে মাথা রাখে। আমি তাকে নেওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। এ অবস্থায় হঠাৎ ১৪-১৫ জন পুলিশ আসে। তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। এমনভাবে গুলি করে যেন খই ফুটতেছে।’
‘আমি হাত তুলে পুলিশকে গুলি না করতে অনুরোধ করি। তার পরও একজন পুলিশ আমারকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তারপর আমার তলপেটে গুলি করে। আমার শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ি। তারপর মাটিতে পড়ে যাই। ওই সময় ছেলেটি আমাকে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। তখন বুঝলাম ছেলেটি মারা গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে পারভীন আরও বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর লোকজন জড়ো হয়। তারা ছেলেটিকে মৃত দেখে আমাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমার চিকিৎসায় অবহেলা করে। অনেকক্ষণ ফেলে রাখার পর একজন নার্স এসে বলে, আপনার চোখে ড্রপ দিতে হবে। আপনার কাছে আড়াইশ টাকা আছে? আমি বললাম, নাই। পরে অপর রোগী টাকা দিলে আমাকে একটি ড্রপ দেওয়া হয়। কিন্তু শরীর থেকে তারা গুলি বের করেনি।
পারভীন সাক্ষ্যদানকালে আরও বলেন, ডাক্তারদের আমি বলি, বাসায় নয় ও চার বছরের দুই সন্তানকে রেখে এসেছি। হাসপাতালের বারান্দায় আমার চিৎকার ও কান্না দেখে একজন এসে বলেন, আপনার বাসার কোনো মোবাইল ফোন নম্বর আছে। আমি নম্বর বললে, তিনি আমার স্বামীকে ফোন দেন। পরে আমার স্বামী বরিশাল থেকে ঢাকায় আসে। ডাক্তারের পা ধরে কান্নাকাটি করে। ডাক্তার টাকা জোগাড় করতে বলেন। পরে আমার বাসায় কানের দুল বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসে। হাসপাতালে আসার পথে আমার স্বামীর ওপর পুলিশ হামলা করে। তার মাথা ফেটে যায়। তার পরও সে ব্যান্ডেজ করে হাসপাতালে আসে। একপর্যায়ে আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়। তিন-চার দিন পর তারা আমাকে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে (জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) পাঠায়। কিন্তু চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে ৫ আগস্টের আগে কেউ চিকিৎসা করেনি। ৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা হয় এবং আমার চোখ থেকে আরও একটি বড় বুলেট বের করা হয়। এ ছাড়া আমার তলপেটে থাকা গুলিগুলো বের করা সম্ভব নয় বলে ডাক্তার জানান এবং মেডিসিন দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে বলেন।
সাক্ষী পারভীন আরও বলেন, ‘আমার নয় ও চার বছরের দুটি সন্তান রয়েছে। আমি বর্তমানে আট মাসের গর্ভবতী। অনেক কষ্ট করে এখানে সাক্ষী দিতে এসেছি। আমি বেঁচে থেকেও ছেলেদের আমি দেখতে পাই না। আমার বাম চোখ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে, ডান চোখে ঝাপসা সামান্য দেখি। সেটিও থাকবে না। বিজ্ঞ আদালত, আমার অন্ধ হওয়ার কারণ ছিল শেখ হাসিনা। হাসিনা ছিল পুলিশের মা-বাবা। পুলিশের খাদ্যদাতা ছিল। তার নির্দেশে পুলিশ আমার মতো হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে আহত করেছে। আমার সন্তানরা তাদের মায়ের অন্ধ হওয়ার বিচার চায়। এ আদালতে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিচার না হলে পরে আর বিচার হবে না। যদি বিচার না হয় দেশে খুন-খারাবি নির্যাতন আরও বেড়ে যাবে। আমি চাই অন্যায়ের বিচার হোক’ বলেন চোখ হারানো পারভীন।

জাকের হোসেন