খোকনের বিকৃত মুখমণ্ডলই জুলাই বর্বরতার প্রতিচ্ছবি
তার বাম চোখ নষ্ট, নাক-মুখ বিকৃত, চোয়াল থেকে মুখ বসে গেছে। জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের নৃশংসতা কেমন ছিল এই অবয়বটিই যেন তার প্রতিচ্ছবি। টগবগে যুবক খোকন চন্দ্র বর্মণকে (২৩) এখন আর চেনা যায় না। তার মতো শত শত যুবক ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় হতাহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্যে খোকন দিয়েছেন সেদিনের নির্মমতার বর্ণনা। আদালতে উপস্থিত সবাই তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন।
মানবতাববিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী দেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত নারায়ণগঞ্জের খোকন চন্দ্র বর্মণ।
চলতি বছরের ৩ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেই। সেখানে সারা দিন আন্দোলনের পর বাসায় ফিরে যাই। পরের দিন ১৯ জুলাই আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়ে ভুঁইঘর থেকে জালকুঁড়ির দিকে যেতে যাচ্ছিলাম। তবে যেতে পারিনি। পথে পুলিশ ও বিজিবি গুলি করে। চোখের সামনে দেখলাম আন্দোলনরত একজনের বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মারা যান। আরও অনেকে আহত ও নিহত হন। এরপর থেকে আমি নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দেই।
খোকন চন্দ্র বর্মণ ট্রাইব্যুনালকে জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল ৯টা, সাড়ে ৯টার দিকে তিনি আন্দোলনে যোগ দিতে সাইনবোর্ড এলাকায় যান। অনেকক্ষণ স্লোগান ও মিছিল করে সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পৌঁছে দেখেন পুলিশ গুলি করছে। তারা পুলিশের সামনে দূর থেকে ‘স্বৈরাচার, ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। পরে যখন সামনে এগোনোর চেষ্টা করেন তখন পুলিশ আবারও গুলি করে। একজনের মাথায় একপাশ দিয়ে গুলি লেগে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর এমনভাবে রক্ত বের হচ্ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল গরু জবাই করা হয়েছে। ওই গুলিটা আরেকজনের গায়ে লাগে এবং সেও আহত হয়। যার মাথায় গুলি লাগে, সে মারা যায়।
ট্রাইব্যুনালকে খোকন চন্দ্র বর্মণ আরও জানান, এরপর সেনাবাহিনী এসে ফাঁকা গুলি করে এবং পুলিশকে থানায় চলে যেতে বলে। পুলিশ সদস্যরা যাত্রাবাড়ী থানায় চলে যায়। তখন তারা সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে স্লোগান দিতে থাকেন। ওই সময় তারা খবর পান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তখন সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চলে যান। সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর থানা থেকে পুলিশ বেরিয়ে এসে সরাসরি মিছিলে গুলি করতে থাকে। তখন যে যার মতো যেখানে পারে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আত্মরক্ষায় তিনিসহ কয়েকজন যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে লুকান। একপর্যায়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে তাদের ‘টার্গেট করে’ গুলি করে। সেখানে যারা ছিলেন, সবাই গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে তিনি ফ্লাইওভারের নিচে থাকা ড্রামের পেছনে আশ্রয় নেন। সেখানে একজন পুলিশ তাকে দেখে মাথা নিশানা করে গুলি করে। সেই গুলি লাগে তার মুখমণ্ডলে। গুলি লাগার পর তার আর বাঁচার আশা ছিল না বলে জানিয়ে মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে ট্রাইব্যুনালে নিজের ক্ষতিগ্রস্ত চেহারা দেখান খোকন।
খোকন চন্দ্র বর্মণ ট্রাইব্যুনালকে জানান, গুলি লাগার পর তার চিৎকারে ছাত্ররা এগিয়ে এসে তাকে ধরে উঠায় এবং তার পকেট থেকে ফোন বের করে পরিবারকে খবর দেয়। এরপর তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে পাঠানো হয় মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে। সেখান থেকে ১০ দিন পর তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। সেখানে ১০ দিন আইসিইউতে ছিলেন তিনি। এই বার্ন ইনস্টিটিউটে তিনি অনেকদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার চিকিৎসা এখনও শেষ হয়নি। গত ২১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠায়। ৭ এপ্রিল দেশে ফেরে আসেন।
এ দেশে তার আর চিকিৎসা হবে না জানিয়ে খোকন চন্দ্র বর্মণ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ১২ আগস্ট চিকিৎসার জন্য আবার রাশিয়ায় যাব। সেখানে ১৮ আগস্ট অপারেশন শুরু হবে।
জুলাই আন্দোলনে ‘হাজার হাজার মানুষকে’ হত্যা করা হয়েছে দাবি করে খোকন চন্দ্র বর্মণ ট্রাইব্যুনালকে বলেন পুলিশ গুলি করে আমার বাম চোখ, নাখ ও মুখ নষ্ট করেছে। এ গণহত্যার জন্য আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, কাউয়া কাদের, শামীম ওসমানের বিচার চাই।
এ সময় প্রসিকিউটর খোকন চন্দ্র বর্মণের কাছে জানতে চান, ‘কাউয়া কাদের’ বলতে তিনি কাকে বোঝাচ্ছেন? তখন একাধিকবার তিনি বলেন, ‘কাউয়া কাদের বলতে আমি ওবায়দুল কাদেরকেই বোঝাচ্ছি।’

জাকের হোসেন