মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘প্রাণভোমরা’ শেখ হাসিনা, কমান্ডার কামাল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে নিউক্লিয়াস বা প্রাণভোমরা ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে এই ‘প্রাণভোমরা’কে অবশ্যই বিচারিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। এই নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলতে হবে, ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের অপরাধের নিউক্লিয়াসের জন্ম না হতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলায় চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে দুই দিনব্যাপী যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
ট্র্যাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের যেসব সদস্যের পাশাপাশি ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ) ও যুবলীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) লোকেরা হামলা করেছেন এবং সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা জড়িত হয়েছেন, প্রত্যেকের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত—তারা এমনটি মনে করতেন। তিনি উল্লেখ করেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য যদি একবার করেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে শেখ হাসিনার এক হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যায় না। যদি শেখ হাসিনাকে এই চরম দণ্ডাদেশটা দেওয়া হয়, তাহলেই ভুক্তভোগীদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে। এত মানুষ হত্যার পরও তার কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো মানুষ হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাগুলো তিনি বারবার বলছেন। তার প্রতি অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
‘কমান্ডার অন দ্য গ্রাউন্ড’ ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল
অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ‘গ্যাং অব ফোর’–এর সদস্য উল্লেখ করে যুক্তিতর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই মাসের প্রতিদিন তার (আসাদুজ্জামান) বাসায় ‘কোর কমিটির’ সভা বসত। তিনি সবকিছু জানতেন, পরিকল্পনা করতেন। শিশুদের যখন মারা হচ্ছিল, তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিষয়টিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আইজিপিকে বলেছেন ‘লেথাল উইপন’ (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের জন্য। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান, আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান—এই চারজন হলেন গ্যাং অব ফোর। কমান্ডার অন দ্য গ্রাউন্ড (মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া) হিসেবে আসাদুজ্জামান খান কাজ করতেন উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই আসামি কোনো অনুকম্পা পাওয়ার অধিকারী নন। আসাদুজ্জামানকেও সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দিতে ট্রাইব্যুনালের প্রতি আরজি জানান তিনি।
ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
এ মামলার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হিসেবে দেওয়া জবানবন্দি তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শর্ত হচ্ছে, যদি তিনি (মামুন) ‘ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার’ (পূর্ণ সত্য প্রকাশ) করেন তাহলে অ্যাপ্রুভার হিসেবে গণ্য হবেন। সাবেক আইজিপি মামুন সাক্ষ্য দিয়েছেন। যত দূর সম্ভব তিনি ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার করেছেন। তিনি শুধু জুলাইয়ের এ মামলা নয়, গুমসহ অন্যান্য অপরাধের ব্যাপারেও তথ্য দিয়েছেন। সেটাকে যদি ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার মনে করেন ট্রাইব্যুনাল, তাহলে যথাযথ আদেশ তাঁর ব্যাপারে দিতে পারেন।
আসামিদের সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণের আবেদন
শেখ হাসিনাসহ এ মামলার আসামিদের সম্পদ থেকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে হতাহতের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, আসামিরা বৈধ ও অবৈধভাবে বিপুল বিত্ত–বৈভবের মালিক হয়েছেন। তারা রাষ্ট্রের সম্পদকে লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। দেশের মধ্যে অঢেল সম্পত্তি গড়েছেন। এই সম্পত্তি থেকে গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তিনি ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানান।
দেশকে রক্ষায় ঢাল হয়েছিল সেনাবাহিনী
চিফ প্রসিকিউটর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি শর্ত হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অথবা সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে এটি সম্পূর্ণরূপে করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হয়েছিল।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যদিও সেনাবাহিনী সেভাবে অ্যাক্ট (ভূমিকা পালন) করেনি। ছাত্রদের সেভাবে হত্যা না করার ব্যাপারে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। শেষের দিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র–জনতা একাকার হয়ে গিয়েছিল। মিরপুরের একটা জায়গায় দেখা গেছে, ছাত্রদের রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী পুলিশের দিকে পাল্টা গুলি ছুড়ছে।
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত দেশকে রক্ষার জন্য মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেনাবাহিনী। তখন মানুষ কিন্তু সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ধরেছে, কান্না করেছে আবেগে। ফুল দিয়েছে, তাদের এপিসির (সাঁজোয়া যান) ওপর পতাকা নিয়ে গেছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যাটাক’ কিংবা ‘সিস্টেমেটিক অ্যাটাক’ যেকোনো একটি প্রমাণিত হলেই মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘প্রমাণিত’ হয়। শেখ ফজলে নূর তাপস, হাসানুল হক ইনু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সারা দেশে সব হামলার ব্যাপারে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণভাবে ‘জ্ঞাত’ ছিলেন। তিনি নিজে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন দ্বিতীয় অবস্থানে। তার বাসায় প্রতি রাতে ‘কোর কমিটির’ বৈঠক হতো। তিনি আইজিপিকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমন কি যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ফলে এটা বলার সুযোগ নেই, অপরাধ এবং অপরাধীদের ব্যপারে তিনি জানতেন না।
যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে জেনেভা কনভেনশনের ৪৯, ৫০ ও ৮৭ ধারা এবং রোম সংবিধির ২৫ (৩) অনুচ্ছেদ তুলে ধরার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতের কয়েকটি রায় ও সিদ্ধান্ত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ তিনটি মামলার অংশ বিশেষ তুলে ধরেন।
চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ওই সব মামলায় যেভাবে ‘ওয়াইডস্প্রেড’ এবং ‘সিস্টেমেটিক অ্যাটাক’ প্রমাণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে এখানে ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। নিরস্ত্র জনগণের ওপর ‘ওয়াইডস্প্রেড’ এবং ‘সিস্টেমেটিক অ্যাটাক’ হয়েছে। এন্টায়ার পপুলেশন অব জিওগ্রাফিক্যাল এনটিটির ওপর অ্যাটাক হয়েছে, লার্জ স্কেলে অ্যাটাক হয়েছে।
যুক্তিতর্কে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের পুরো ফোর্সকে শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছেন। বিজিবি, পুলিশ, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থাকে; শুধু সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেননি। তাই সেনাবাহিনীকে বলা হয় দেশপ্রেমিক। রাস্তায় দেখলে মানুষ তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে। ৩ আগস্ট দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে জনগণের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণ তাদের ফুল দিয়েছে, চুমু খেয়েছে।’
চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে আরও বলেন, জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের নিউক্লিয়াস ছিলেন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট অপরাধ সংঘটনের পর পালিয়ে গেলেও ভারত থেকে ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। সেখানে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনবরত কথা বলছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, এত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার পরও তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তিনি একজন হার্ডেন্ড ক্রিমিনালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এই মামলায় তিনি যেহেতু সব অপরাধীর প্রাণভোমরা ছিলেন, তাই তাকে আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দেওয়াই শ্রেয়। তার প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ এই আইনে নেই।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, শুধু কোটা আন্দোলন দমন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, তাদের এ নৃশংসতার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। তাই তারা নিরস্ত্র জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনার এসব কাজে চরম জিঘাংসা ফুটে উঠেছে। এক হাজার ৪০০ মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। একেকজনের জন্য একবার মৃত্যুদণ্ড হলে তাঁর এক হাজার ৪০০ বার হওয়া উচিত। তবে একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের এই ভিকটিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে যদি তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশটা দেওয়া হয়।

জাকের হোসেন