ন্যায়বিচার না হলে ইতিহাসে ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে থাকবে বাংলাদেশ
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো শাসক-শোষক বা ফ্যাসিস্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম তারা ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। তাদের যদি সাহস থাকত তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে তারা এই বিচারের মুখোমুখি হতেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মো. আসাদুজ্জামান এ কথা উল্লেখ করে বলেছেন, আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি এবং শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের যদি শাস্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের মানুষ।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপক্ষ পাঁচ দিনব্যাপী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। আসামিপক্ষ দুই দিনে যুক্তিতর্ক শেষ করে। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর আসামিদের শাস্তি চেয়ে যুক্তি তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
যুক্তিতর্ক খণ্ডনের সময় মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো শাসক-শোষক বা ফ্যাসিস্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন তারা। যদি সাহস থাকত তাহলে তিনিসহ (শেখ হাসনা) তারা বাংলাদেশের মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখি হতেন। ন্যায়বিচার শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি বা এই দুজনের বিচার ব্যাহত হয় অথবা শাস্তি না হয় যেটা আইনে প্রেসক্রাইব করা আছে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সেই কারণেই আমরা মনে করি, এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি–সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ কথা বলেন।
যুক্তিতর্কের শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সুরা নিসাসহ দুটি সুরার আয়াতের রেফারেন্স টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আজ আমি ন্যায়বিচারের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক ও মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন পক্ষ। আসামিদের আইনজীবীর যুক্ততর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাগ্যিস তারা বলেননি, এ দেশে কোনো জুলাই রেভ্যুলেশন হয়নি, কেউ মারা যায়নি কিংবা আহত হয়নি। অথচ বাংলাদেশে এক হাজার ৪০০ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এত বড় একটা জুলাই রেভ্যুলেশন হলো, হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস বা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে।
একপর্যায়ে আটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাধার প্রাচীর আসুক, সেটা ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিনগুলোতে এগুতে পারব না। আমি একটা বিচারের মানদণ্ড তুলে ধরতে চাই। ১৯৫১ সালে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করেছিলেন আমেরিকান আদালত। সেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও ইথেল রোজেনবার্গ। এ দম্পতির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ছিল। তাদের কারণে কোরীয় দ্বীপে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ মারা গেছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব জেগে উঠেছিল। সব নোবেল বিজয়ী, বিজ্ঞানী এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। খালাস দিতে বলেছিলেন। এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে শেষ পর্যন্ত তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুজন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। আমরাও এ আসামিদেরও মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও তা কার্যকারের দাবি জানাচ্ছি।
আসামিদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা রেখে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এই আসামিরা বলবেন যেমন বলেছিলেন জুলিয়াস নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা ও অন্য যেসব জিনিস জীবনকে সত্যিই সুন্দর-স্বার্থক করে তোলে তা পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়। তারা হয়তো এমন একটি উক্তি দিয়েই এই বিচারের রায় মেনে নেবেন। অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন না। অন্য কোনো পথে তারা হাঁটবেন না। যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি গড়ে তোলা যায়।’
ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করেছিলাম, শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হবেন। কারণ তিনি অন্যের উদ্দেশে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বিচারের মুখোমুখি হন। কিন্তু তিনি এই কথা মন থেকে বলেননি। বললে আজ দেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হতেন।’
মো. আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘এই আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের আরও অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ভীরু-কাপুরুষ হয়ে রয়ে যাবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি। কেননা গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি অবিচার করা হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। দুই পক্ষই যেকোনো মূল্যে ন্যায়বিচার পাবে।‘

জাকের হোসেন