চলনবিল থেকে অপরিকল্পিত শামুক নিধন, বিপর্যয়ে জীববৈচিত্র্য
পাবনার চলনবিলসহ বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ১০-১৫টি খাল-বিল থেকে অবাধে শিকার করা হচ্ছে শামুক। এগুলো শিকার বা নিধন করে নিজেদের হাঁস ও মাছের খামারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কেজি দরে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে এ শামুক শিকার দ্রুত রোধ করা না গেলে জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানি নামতে শুরু করায় চাটমোহরের চলনবিল, সাঁথিয়া উপজেলার মুক্তার বিল, বিল গাংভাঙ্গা, গজারিয়া, আড়িয়াদাহ বিল, বেড়া উপজেলার জোরদহ বিল, ধলাই, ট্যাংরাগাড়ি, বক্কারের বিলসহ বিভিন্ন খাল ও বিল থেকে হাজার হাজার মণ শামুক শিকার করে শিকারীরা। পরে সেগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে ট্রাকে ভরে খুলনাসহ বেশকিছু অঞ্চলে সরবরাহ করেন।
শামুক শিকারী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শামুকের ভালো চাহিদা থাকায় নৌকা নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মই জাল, হেসি জাল ও হাত দিয়ে শামুক সংগ্রহ করেন নারীরাসহ বিল পাড়ের বাসিন্দারা। পরে এসব শামুক পাইকারদের কাছে পাঁচ থেকে সাত টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। এসব সংগ্রহকারীদের বড় অংশ জানে না শামুক শিকার, ক্রয়-বিক্রয় বা বিপণন সংক্রান্ত কোনো আইন। এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জানানোর পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরের নেই তেমন উদ্যোগ। ফলে অবাধে শামুক শিকার করে বিক্রি চলছে পুরোদমে। সরেজমিন সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের শামুকজানি গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে সে চিত্র।
শামুকজানি গ্রামের শামুক শিকারী হেকিম শেখ বলেন, বর্ষায় হাতে কাজ কাম কম থাকে। তাই মই জাল, হেসি জাল ও হাত দিয়ে শামুক সংগ্রহ করি। এতে কিছু টাকা আয় হয়।
বেড়া উপজেলার তারাপুর গ্রামের হাসনা খাতুন বলেন, গরিব মানুষ এই বাজারে চলা কষ্ট। তাই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় শামুক কুড়াই। শামুক বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়।
সাঁথিয়ার শামুক ব্যবসায়ী আজমত শেখ বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ বস্তা শামুক বেচাকেনা হয়। সাঁথিয়ার অন্যান্য জায়গায় আরও বেশি বেচাকেনা হয়। ক্রয় করে অল্প লাভে আমরা খুলনায় সরবরাহ করি। এসবের কোনো আইনকানুন তো জানি না।
এদিকে অপরিকল্পিতভাবে এসব খাল-বিলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নিধনের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হারানোর শঙ্কা করছেন অনেকেই। হুমকির মুখে পড়বে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে ফসলি জমির উর্বরতাও হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
এ ব্যাপারে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামানিক বলেন, শামুক মাটিতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নির্বিচারে শামুক নিধন উচিত নয়। এটি সরাসরি ফসলে প্রভাব না ফেললেও জীববৈচিত্র্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। যেটি কৃষিতে গিয়েও পড়বে। এ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের তেমন নির্দেশনা না থাকলেও সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরাও কাজ করব।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, শামুকের ছোট ডিম ও বাচ্চাগুলো খেয়ে কিছু মাছ বেঁচে থাকে। এ ছাড়া শামুক নিচের ময়লা খেয়ে পানি পরিষ্কার রাখে। এটি শুধু মাছ নয় অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্যও ইতিবাচক বিষয়। এ ক্ষেত্রে বিল বা খালে শামুক প্রয়োজনীয় হারের তুলনায় কম হয়ে গেলে সেটি মাছ বা জলজ অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর বিষয় হবে। কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরা তেমন পদক্ষেপ নিতে পারি না। তবে এটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর জানান, পানিতে শামুক না থাকলে পানির প্রাকৃতিক শোধন ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাংলাদেশ সরকারের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী শামুক সংগ্রহ, ধ্বংস, ভক্ষণ, পরিবহণ, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি দণ্ডনীয় অপরাধ, যার সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। তবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অতি জরুরি বলেও জানান তিনি।

এ বি এম ফজলুর রহমান, পাবনা