গাছি সংকটে খেজুর রসের ঐতিহ্য টিকে থাকার শঙ্কা
পটুয়াখালী জেলায় খেজুর রস উৎপাদন দিন দিন কমে যাওয়ায় শীতকালীন ঐতিহ্য হারানোর শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। জেলার বিভিন্ন উপজেলার মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে খেজুর গাছের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস ও গুড় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন কমে যাওয়ায় উৎপাদকরা পর্যাপ্ত আর্থিক লাভ করতে পারছেন না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, জেলায় বর্তমানে খেজুর গাছ রয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৫টি। গত মৌসুমে আহরিত গুড়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪.১ মেট্রিক টন। জেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, উল্লেখযোগ্য অংশের রস সরাসরি বাজারে বিক্রি হওয়ায় গুড় উৎপাদন তুলনামূলক কম হয়েছে।
বাউফল উপজেলার চাষি আবদুল করিম বলেন, আগে তার ৩০ থেকে ৩৫টি খেজুর গাছ থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লিটার রস পাওয়া যেত। এখন তিনি ১৬টা গাছ কাটেন, কিন্তু রস নেমে এসেছে ৪ থেকে ৬ লিটারে। রসের দাম লিটার প্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় আগের তুলনায় লাভের সুযোগ অনেক কমে গেছে।
দশমিনা উপজেলার অভিজ্ঞ গাছি সামছুল হাওলাদার বলেন, একসময় একটি মৌসুমে ২০০ থেকে ২৫০ কেজি পাটালি গুড় তৈরি হতো। এখন তা কমে ৫০ থেকে ৭০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পাটালির কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং নলেন গুড় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও সরবরাহ সীমিত হওয়ায় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মির্জাগঞ্জের ক্ষুদ্র চাষি রোকন উদ্দিন জানান, আগে আমার ৩০টির বেশি খেজুরগাছ ছিল, এখন আছে মাত্র ৮টি। উৎপাদন কমে মৌসুমভিত্তিক আয়ও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
স্থানীয় চাষি ও উৎপাদকরা জানান, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, নতুন গাছ রোপণ, গাছি প্রশিক্ষণ এবং বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করলে দক্ষিণাঞ্চলে খেজুর রস ও গুড় উৎপাদন পুনরায় বাড়ানো সম্ভব।
বাউফল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং অযত্নে পড়ে থাকা গাছের উচ্চ মৃত্যু হারই খেজুরগাছ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। দক্ষ গাছির অভাবও বড় সমস্যা। আমরা নতুন গাছ রোপণে উৎসাহ দিচ্ছি এবং আগামী মৌসুমে গাছিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। আধুনিক নলী প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রস আহরণ অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হবে বলে আশা রাখি।
বাউফল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম বলেন, খেজুর গাছ চাষ ধরে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন কৃষি দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন সহায়তা ও প্রণোদনা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন গাছ রোপণ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে আমরা সহায়তা প্রদান করব।
কৃষির উপপরিচালক ড. মো. আমানুল ইসলাম বলেন, মানুষ এখন আর নতুন করে খেজুরগাছ রোপণ করে না; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খেজুরগাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক গাছ কাটার সময় নষ্ট হয়ে যায়। জ্বালানি খরচ বাড়ায় গুড় উৎপাদন কমেছে। কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় গাছিরা কাঁচা রস বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন, ফলে ঐতিহ্যবাহী খেজুরগুড় তৈরির প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণে নতুন করে খেজুরগাছ রোপণ অপরিহার্য। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রণোদনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে রোপণ কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)