সেন্টমার্টিনে ১০ মাস পর গেল পর্যটকবাহী জাহাজ
প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে দীর্ঘ ১০ মাস পর বাজল পর্যটকবাহী জাহাজের হুইসেল। আবারও পর্যটকে মুখর হলো এই দ্বীপ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আর আনন্দে উৎফুল্ল দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা।
আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে জাহাজ থেকে নামতেই পর্যটকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে সরকারি প্রজ্ঞাপনে নভেম্বর মাসেই দ্বীপে পর্যটক প্রবেশের নির্দেশনা ছিল। রাত্রি যাপন করা যাবে না বলে কোনো পর্যটক যায়নি।
পর্যটকবাহী জাহাজ এমভি বার আউলিয়া সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে নোঙর করে। এর কিছুক্ষণ পরই পৌঁছে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ও কেয়ারি সিন্দাবাদ। তিন জাহাজে মোট এক হাজার ২০০ পর্যটক দ্বীপে পা রাখে।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএর ঘাট থেকে রওনা হয় জাহাজগুলো। ঘাটেই ছিল প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, পর্যটকদের টিকিট যাচাই এবং কিউআর কোড স্ক্যান করে নিশ্চিত করা হয় যাতে নির্ধারিত সংখ্যার বেশি মানুষ দ্বীপে প্রবেশ করতে না পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা মীর আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধের মতো অবস্থা ছিল। আজ আবার মানুষ দেখছি, দোকান খুলেছি। মনে হলো, দ্বীপটা আবার বেঁচে উঠল।’
আরেক বাসিন্দা ওসমান গনি বলেন, ‘পর্যটন আমাদের জীবিকা, কিন্তু পরিবেশও বুঝতে হবে। এবার যে নিয়ম-কানুন কঠোর করা হয়েছে, এতে প্রবাল আর প্রকৃতি একটু হলেও বাঁচবে বলে আশা করি।’
ময়মনসিংহ থেকে আসা পর্যটক সাদিয়া নৌরিন প্রথমবার সেন্টমার্টিনে এসেছেন জানিয়ে বলেন, ‘নৌযাত্রাটা দারুণ ছিল। দ্বীপে নামার পরই মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছি। এত দিন অপেক্ষা করে এসে সত্যিই ভালো লাগছে।’
আজহারুল ইসলাম নামের আরেক পর্যটক বলেন ‘দ্বীপে প্রবেশের সময় কিউআর কোড স্ক্যান, তথ্য যাচাই, সবই খুব সুশৃঙ্খল লাগল। নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত। এবার একটু গুছানো মনে হয়েছে।’
নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে জেলা প্রশাসক আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ থেকে সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন করা যাবে। সব কিছু অনলাইন টিকিট ও ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে—যাতে পরিবেশবহুল দ্বীপে অতিরিক্ত পর্যটক না ঢোকে। প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণে প্রচারণা চলছে, এবং বিকল্প হিসেবে এলুমিনিয়ামের বোতল দেওয়া হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক জানান, দ্বীপ ও কক্সবাজার এলাকায় সরকারের দেওয়া ১২ নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভলান্টিয়ার দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘাটে, প্রতিটি জাহাজে এবং দ্বীপে পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন আছে। সার্বক্ষণিক সেবা এবং নজরদারি চলছে। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সহযোগিতা করছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, ‘জাহাজগুলো কঠোর নজরদারিতে থাকবে এবং দৈনিক দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া হবে না। নুনিয়ারছড়া ও সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে পৃথক তল্লাশির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
জানা গেছে, আরও চারটি জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি পেলেই ধাপে ধাপে সেগুলোও রুটে নামবে। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাস নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকেই পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল অব্যাহত থাকবে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত ২২ অক্টোবর ১২টি নির্দেশনাসহ প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ ছিল। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস পর্যটকরা ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন, তবে মেনে চলতে হবে সরকারের ১২ নির্দেশনা।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্দেশনাগুলো হলো, নভেম্বরে দিনভর ভ্রমণের সুযোগ থাকবে; রাতযাপন নিষিদ্ধ। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাতযাপন করা যাবে।
এ ছাড়া অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান সেন্টমার্টিনে যাতায়াত করতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টাল থেকে অনলাইনে টিকিট নিতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে; কিউআর কোড-বিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।
আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার টানা নয় মাস সেন্টমার্টিনে পর্যটক প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকবে। ভ্রমণ সময়সূচি ও পর্যটকসংখ্যা এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয় এবং সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ যেকোনো জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যান চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে।
ভ্রমণকালে পলিথিন বহন করা যাবে না। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ বা ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজেদের পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

নোমান অরুপ, কক্সবাজার (টেকনাফ)