সেনা কর্মকর্তাদের সশরীরেই ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হবে
আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় টিএফআই সেলে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার ১০ সেনা কর্মকর্তাকে সশরীরের হাজির না হয়ে ভার্চুয়ালি শুনানির আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ফলে আগামী ১৪ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানিতে সশরীরেই সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে হবে।
আজ বুধবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. তোবারক হোসেন ভুইয়া। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানিতে আইনজীবী ড. তোবারক হোসেন ভুইয়া বলেন, রায় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেনাবাহিনীর এসব কর্মকর্তা অপরাধী না। তাই এরা যদি পরবর্তীতে খালাস পান তাহলে এরা তো চাকুরিতে ফিরে যেতে পারবেন না। তাছাড়া তাদের সামাজিকভাবে ও মিডিয়ার মাধ্যমে সমস্যায় পড়ছেন।
এ সময় বিচারক বলেন, এখানে সেনা আইনে বিচার হচ্ছে না। দেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতি যদি আসতে পারে তাহলে তারা আসতে বাঁধা কোথায়?
জবাবে ওই আইনজীবী আবারও বলেন, সেনাবাহিনী ও এয়ারফোর্সের লোকজনকে বিচারের পর খালাস পেলেও তাদের আর বাহিনীতে ফেরৎ নেওয়া হয় না।
এ সময় বিচারক বলেন, এখানে ভার্চুয়ালি শুনানি রাখার সুযোগ নেই। আইনে কভার করে না, সবাই সমান।
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, মাই লর্ড উনি মিস গাইড করছেন। এখানে কোনো বাহিনীর বিচার হচ্ছে না। এসব আসামিরা দেশের সেনাবাহনী থেকে র্যাবে ডেপুটেশনে গিয়ে দায়িত্বরত অবস্থায় ছিল। তাদের বিচার হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এতে করে তারা খালাস পাওয়ার শূন্যভাগও সুযোগ নেই।
এ সময় ট্যাইব্যুনাল বলেন, জুডিশিয়ারিতে অনেক বিচারক রয়েছেন যারা ডেপুটেশনে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দায়িত্বপালন করেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে দুর্নীতির। সেটা বিাচরক হিসেবে নয়, সচিব হিসেবে। তাই এখানে বাহিনীর লোক হিসেবে তাদের অপরাধ নয়। বরং তারা ডেপুটেশনে গিয়ে গুম খুন করেছে সেটা বিবেচ্য হবে।
জবাবে আসামিদের আইনজীবী বলেন, মাই লর্ড কিন্তু বাহিনীর আইনে যদি তারা কোন কারণে খালাস পায় তাদের আর ফেরৎ নেবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো পেশায় এমন নেয় যে, ২৪ ঘণ্টা জলে বা স্থলে দায়িত্ব পালনের শপথ করতে হয়। একমাত্র তিন বাহিনীতে কোরআন শপথ করে বলতে হয়। কেননা তাদের তো যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়। তাই রায়ের পূর্বে যদি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়, তাহলে এরাতো বাহিনীতে আর ফিরতে পারবে না।
জবাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারক বলেন, এটার সুযোগ নেই। আপনার আবেদন না মঞ্জুর করা হলো।
শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই বিচারকে মুখোমুখি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যা এই শুনানির সময় আমরা লক্ষ্য করেছি।
তাজুল ইসলাম বলেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেছেন যে এই বিচার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। আমরাও সুস্পষ্টভাবে বলেছি, এটি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিচার নয়। কারণ, সামরিক শৃঙ্খলার বাইরে থাকা অবস্থায় আসামিরা এসব মারাত্মক অপরাধ করেছেন। তখন তারা র্যাবে ছিলেন। এসব অপরাধকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলা হয়। সুতরাং তাদের পক্ষে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রার্থনা খারিজ করেছেন আদালত।
আদালত বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকই সমান। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো গুরুতর। তাই সবাইকে সমান সুবিধা দেওয়া হবে। বিচারের সাজাপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা ইনোসেন্ট বিবেচিত হবেন। কিন্তু আসামি হিসেবে অন্যরা যে ধরনের সুবিধা ভোগ করেন, এর বাইরে নতুন কিছু পাবেন না তারা।
গত ২৩ নভেম্বর এ আবেদন করা হয়। পরে এ নিয়ে শুনানির জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, বিভিন্ন মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি জেলে রয়েছেন। তিনি সশরীরে হাজির হচ্ছেন। সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। আইন সবার জন্য সমান।
এ মামলায় গ্রেপ্তার ১০ সেনা কর্মকর্তা হলেন- র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
পলাতক আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ ও র্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. খায়রুল ইসলাম।
এর আগে, গত ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ১০ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। একইসঙ্গে পলাতক আসামিদের হাজিরের জন্য সাতদিনের মধ্যে দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত তারিখে হাজির না হওয়ায় তাদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন আদালত। ৮ অক্টোবর এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। পরে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক