‘তুলে নিয়ে আনিসুল-আরাফাত-নওফেলের সঙ্গে মিটিংয়ের চাপ দেওয়া হয়’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেওয়া জবানবন্দিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ডিজিএফআই সদস্যরা আমার মামার বাসায় এসে সারজিস ও আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আমরা যেতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদের পরিবারসহ আমাদেরকে ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়।
প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা নিয়ে তিন মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংয়ের চাপ দেওয়া হয়। ব্যর্থ হয়ে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এর মাঝে গোপন স্থানে যা সেইফ হাউজ নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে আটক রাখে। সেখানে আমাদেরকে ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বাহির থেকে একটি পরিত্যাক্ত বাড়ি মনে হলেও তার ভিতরটা ছিল আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত।
আজ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে জবানবন্দিকালে তিনি এসব কথা বলেন। এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জন আসামি রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।
জবানবন্দিতে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলাম। আমরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার যে আন্দোলন হয়, সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সেই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোটা সংস্কার করা কিন্তু তৎকালীন প্রশাসনিক প্রধান ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে সংস্কার না করে পুরো কোটা প্রথাই বাতিল করে দেন, যাতে পরবর্তীতে এ কোটা প্রথা আবার চালু করা যায়। আমরা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এই কোটা প্রথা আবার পুনর্বহাল করা হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে কেউ একজন রিট দাখিল করেন। কোন প্রেক্ষাপট ছাড়াই ২০২৪ সালে ওই রিট মামলার রায়ে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিলপূর্বক কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। এর ফলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং সারা দেশে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আমরা ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগের রায় প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ করি।
আন্দোলনের তীব্রতার কথা উল্লেখ করে হাসনাত বলেন, ঈদুল আযহার বন্ধ শেষে ১ জুলাই ২০২৪ সাল থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আমরা আন্দোলন আবার শুরু করি। সরকার হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে মাননীয় আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করলে ৩০ দিনের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই স্থিতাবস্থার ফলে ছাত্র সমাজ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আমরা হাইকোর্ট বিভাগের রায় স্থগিত রেখে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল চেয়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের রায় স্থগিত না করে চার সপ্তাহের জন্য শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, সরকার বিচার বিভাগকে দলীয় করণ করে নিজস্বার্থ বাস্তবায়ন করছে।
আমরা ৭ জুলাই ২০২৪ ইং তারিখে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১১ জুলাই ডিজিএফআইয়ের সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন আমাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষে যোগাযোগ করেন এবং আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য জানতে চান। তিনি আমাদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চান এবং আন্দোলন বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
১৪ জুলাই আমরা কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করি। ওইদিন রাতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে ফেরত এসে একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদেরকে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ এবং ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেন। এর প্রতিবাদে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসে। ওইদিন রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে আসতে বাধা প্রদান করে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের হেনস্তা করে।
ছাত্রলীগের শাকিরুল আমাকে পিটিয়ে গোড়ালি মচকে দেয়
জবানবন্দিতে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, পরদিন ১৫ জুলাই দুপুর ১২টায় আমরা রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিই। ওই সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগ একই সময়ে একই স্থানে কর্মসূচি ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন যে, এই আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এই বক্তব্য স্পষ্টতই উসকানিমূলক বক্তব্য ছিল।
১৫ জুলাই আমরা যখন রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর হয়ে হলের দিকে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন সাদ্দাম, এনান, সৈকত, শয়নের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর আক্রমণ করে এবং নারী শিক্ষার্থীদেরকে হেনস্তা করে, যা সারা দেশবাসীকে সংক্ষুব্ধ করে। ওই আক্রমণে আমাকে রেজিষ্টার বিল্ডিংয়ের সামনে বিজয় ৭১ হলের ছাত্রলীগ নেতা শাকিরুল ইসলাম শাকিব আমাকে পিটিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি মচকে দেয়। তৎক্ষণাৎ আমাকে লালবাগ ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। সেদিন শিক্ষার্থীদেরকে পিটিয়ে আহত করা হয়। শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতলে গেলে ছাত্রলীগ হাসপাতালে প্রবেশ করে আহত ছাত্রদের ওপর পুনরায় হামলা করে এবং চিকিৎসা নিতে বাধা প্রদান করে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই সারা দেশে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়। ১৬ জুলাই সারা দেশে যখন শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করছে তখন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও একজন সমন্বয়ক আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ওইদিন চট্টগ্রামের ষোলশহরে ছাত্রদলের ওয়াসিমসহ সারাদেশে মোট ছয়জনকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ গুলি করে হত্যা করে।
১৭ জুলাই আমরা ছয়জন হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে গায়েবানা জানাজা পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ওইদিনই ইউজিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল বিকেল ৫টার মধ্যে খালি করার নির্দেশ দেন। আমরা অমর একুশে হল থেকে মিছিল নিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসির দিকে আসতে চাইলে রাজু ভাস্কর্যের সামনে পুলিশ ও বিজিবি আমাদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একই সঙ্গে ডিজিএফআই আমাদেরকে গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আমরা যখন গায়েবানা জানাজা শেষ করে কফিন মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরা আমাদের ওপর পুনরায় টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে আমিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র আহত হয়। আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করে। ওইদিন ডাকসুর নির্বাচিত সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামার বাসা থেকে তুলে নিয়ে তিন মন্ত্রীর সাথে মিটিংয়ের চাপ দেওয়া হয়
জবানবন্দিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ওইদিন আমি সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আমার মামার বাসায় চলে যাই। যেহেতু হল বন্ধ করে দেয় আমার সঙ্গে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিসও আমার মামার বাসায় চলে আসে। সেদিন রাতে ডিজিএফআই সদস্যরা আমার মামার বাসায় এসে সারজিস ও আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আমরা যেতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদের পরিবারসহ আমাদেরকে ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়। ওইদিন রাতে আমাদেরকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে সেখানে তৎকালীন তিনজন মন্ত্রী আনিসুল হক, আরাফাত ও নওফেল প্রবেশ করেন। ডিজিএফআইয়ের সদস্যরা তাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং করতে চাপ প্রয়োগ করেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় নানাবিধ প্রলোভন, ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে শুধু মিটিং করতে বলেন। অন্য সমন্বয়ক নাহিদ, আসিফের সঙ্গে কথা না বলে আমরা যেকোনো ধরনের মিটিং করতে অস্বীকৃতি জানাই। ডিজিএফআই পীড়াপীড়ি করে আমাদের মিটিংয়ে বসাতে ব্যর্থ হলে সেদিন আমাদের সামনে দিয়ে আবার ওই তিনজন মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা থেকে বের হয়ে যান। সেদিন মিটিং না করায় ডিজিএফআই আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ডিজিএফআই আমাদেরকে বাসায় ফেরত না দিয়ে সেদিন রাতে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝে একটি গোপন স্থানে, যা সেইফ হাউজ নামে পরিচিত, নিয়ে আটক রাখে। সেখানে আমাদেরকে ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমাদেরকে যেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার ঠিক পেছনে একটি টেলিভিশন সেট করা ছিল। আমাদেরকে যিনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সঙ্গে টিভি দেখছিলেন কিন্তু আমরা আমাদের পেছনে থাকা টিভি দেখতে পারছিলাম না। তিনি সেখান থেকে ফোন করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, বিশেষ করে ডিবিসি, সময় টিভি ও একাত্তর টিভিতে ফোন করে নিউজ পরিবর্তন এবং স্ক্রল সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সে অনুযায়ী টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচার করছিল এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক মর্মে দেখানোর চেষ্টা করছিল। আমাদেরকে যে বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তা বাহির থেকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি মনে হলেও তার ভেতরটা ছিল আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত।
আমার ফোন দিয়ে হাসিবের অবস্থান নির্ণয় করায় আমি বিব্রত হই
জবানবন্দিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ১৭ জুলাই দিবাগত রাতে প্রায় ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফজরের সময় আমাদেরকে আবার ডেকে তোলা হয় এবং পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জিজ্ঞাসাবাদকালে ডিজিএফআইয়ের একজন সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেন যে, তিনি ২৮ অক্টোবর তারিখে ১০ মিনিটে বিএনপির লাখো জনতার আন্দোলন নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এবং আমাদের আন্দোলন একইভাবে নস্যাৎ করতে তার সময় লাগবে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সেটআপ আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা আমাদেরকে চাপ দিচ্ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করে সরকারের সঙ্গে আলোচনা বসতে এবং সেটি সংবাদ সম্মেলন করে জাতির কাছে জানাতে।
সে সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমরা আমাদের অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।
ডিজিএফআইয়ের সদস্যরা আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে হাসিবের অবস্থান নির্ণয় করে। হাসিবকে চানখারপুল থেকে তুলে এনে আমাদের সঙ্গে আটকে রাখে। সেখানে আমাদেরকে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সমন্বয়ক হাসিব মাদ্রাসার ছাত্র হওয়ায় এবং খুব সম্ভবত তার বোন মাদ্রাসার ছাত্রী হওয়ায় তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।
জবানবন্দিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন,আমার ফোন দিয়ে হাসিবের অবস্থান নির্ণয় করতে পারায় আমি নিজে বিব্রত হই এবং আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। আটক থাকা অবস্থায় আমরা জানতে পারছিলাম না সারা দেশে কী হচ্ছে এবং দেশবাসীও জানতে পারছিল না আমাদের সঙ্গে কী হচ্ছে। দেশবাসীর কাছে আমাদেরকে ভিলেন বানানোর উদ্দেশ্যে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি মর্মে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করা হয়। আমাদেরকে যখনই মিডিয়ার সামনে আনা হচ্ছিল তখনই আমরা বলছিলাম আমাদের পূর্ব ঘোষিত শাটডাউন কর্মসূচি ও আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গণ মাধ্যম টিভি চ্যানেল, বিশেষ করে তিনটি চ্যানেল সময় টিভি, একাত্তর টিভি ও ডিবিসি আমাদের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল।
ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন ডিজি জেনারেল হামিদের পিএস পরিচয়ে নিলয় নামে একজনসহ হাসনাত নামে অপর একজন সেনা কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে রুঢ় আচরণ করে এবং আমাদের গায়ে হাত তুলে। পূর্ব বর্ণিত হাসনাত নামীয় সেনা কর্মকর্তা ডিজিএফআইয়ের পক্ষে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
১৮ জুলাই সারাদিন আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ডিজিএফআইয়ের ডিজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওই সেইফ হাউজে উপস্থিত হয়ে সর্বশেষবারের মতো আমাদের মিটিং করে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগ করেন। বিভিন্ন সংস্থা যেমন-এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই, ডিবিসহ সকল গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে আন্দোলন দমনের ক্রেডিট নেওয়ার প্রতিযোগিতা দেখতে পাই।
আমরা যেহেতু বাহিরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না সেহেতু আমি, সারজিস ও হাসিব সিদ্ধান্ত নেই আমাদেরকে প্রেস কনফারেন্স করে আমাদের দাবি দাওয়া জানাতে দিলে আমরা পদ্মায় যাব। সে শর্তে আমরা পদ্মায় যেতে রাজি হই এবং প্রেস কনফারেন্স করে আমাদের দাবি দাওয়া লিখিতভাবে প্রকাশ করি।
আমরা প্রেস কনফারেন্সে বারবার বলি যে, আমরা সরকারের সঙ্গে কোনো মিটিংয়ে আসি নাই এবং শহিদদের রক্ত মাড়িয়ে আমরা কোনো সংলাপ করতে পারি না এবং আমাদের পূর্ব ঘোষিত শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। দুঃখজনকভাবে মিডিয়া আমাদের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে। শাটডাউন কর্মসূচি যেন প্রত্যাহার করে নেই সেজন্য মিডিয়ার সামনেই পূর্ব উল্লিখিত সেনা কর্মকর্তা হাসনাত আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। আমরা অস্বীকৃতি জানালে তিনি তখন কিছু না বলে আমাদেরকে পুনরায় সেইফ হাউজে নিয়ে আসেন। সেখানে এসে দেখি আমাদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে প্রচার করে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি মর্মে খবর পরিবেশিত হতে থাকে, যা বাস্তব ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
প্রেস কনফারেন্সে আমাদের কথা কেটে দিয়ে শুধু দাবিগুলো প্রচারিত হতে থাকে। সেদিন রাতে আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ জুলাই দুপুরে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক