তফসিল দ্বারপ্রান্তে
গ্রাম কিংবা শহর। চারিদিকে নির্বাচনি হাওয়া বইছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল ঘোষণা এখন কেবল ‘সময়ের ব্যাপার’।
আজ বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায়ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন তফসিল ঘোষণা করতে পারেন। জানিয়ে দিতে পারেন ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ। তবে, তিনি যদি বুধবার তফসিল ঘোষণা না করেন, বৃহস্পতিবার তফসিল হবে। এমনটা নিশ্চিত করছেন একাধিক নির্বাচন কমিশনার।
জানা গেছে, আজ বুধবার বিকেলে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আসতে বলা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জাতির উদ্দেশে যে ভাষণের মাধ্যমে তফসিল ঘোষণা করবেন, সেটি আজ বুধবার রেকর্ড করা হবে।
বিটিভির একটি সূত্রের দাবি, ১০ ডিসেম্বর বিকেলে সিইসির ভাষণ রেকর্ড করতে যাওয়ার কথা। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতির উদ্দেশে তা প্রচারে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, এমন হতে পারে বুধবার ভাষণ রেকর্ড করে তা সন্ধ্যায় প্রচার করতে পারে। এ সম্ভাবনা কম না। আর যদি তা না করা হয়, বৃহস্পতিবার তফসিল।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ইসির আরেক কর্মকর্তা জানান, ইসি থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য নির্বাচন পরিচালনাবিধি ও নির্বাচনি আচরণবিধি সংক্রান্ত আইন পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতের মধ্যে এগুলোর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ভেটিংয়ের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে বলে তিনি জেনেছেন।
আরেকটি সূত্র বলছে, আজ বুধবার বিকেলে তফসিল রেকর্ডের পর সন্ধ্যার দিকে তফসিল ঘোষণা করতে পারেন সিইসি। গত রোববার কমিশনের দশম সভায় ভোটের তফসিল চূড়ান্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে সার্বিক অগ্রগতি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশন।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সিইসি। আজ বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দুপুরে ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি। এরপর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ রেকর্ড করবেন সিইসি।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণার জন্য ভাষণের সবকিছু চূড়ান্ত। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এদিন সন্ধ্যায় অথবা বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) তফসিল ঘোষণা করা হবে।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। তফসিল ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আসন বিন্যাস, আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যারা থাকবেন তাদের প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিষয়ে ২০টির মতো পরিপত্র জারি হবে। সেখানে মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলার সেল গঠন- এগুলোর ফরমেট রেডি রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরপর সেগুলো ধারাবাহিকভাবে আমরা জারি করব।
নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তফসিলের আগে সর্বশেষ গত সোমবার সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের সব নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন। এ বৈঠকে সিইসিসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য কর্মকর্তাদের নানান দিক-নির্দেশনা দেন।
অনলাইনের মাধ্যমে সোমবার অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মাঠ কর্মকর্তাদের (আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা. অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্ত, সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) নির্বাচনে করণীয় ও বর্জনীয় বার্তা দিতে অনলাইন বৈঠকে ডাকে। অনিয়ম করলে কঠোর শাস্তির হঁশিয়ারিও উচ্চরণ করেন তারা। কিন্তু, বৈঠকে উপস্থিত কোনো কর্মকর্তাকে ওই বৈঠকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে, কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তাদের দাবি, বিভিন্ন অঞ্চলে কোথায় কি সুবিধা-অসুবিধা কিংবা সমস্যা; তা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভালো জানেন। পরিস্থিতি বোঝার জন্য হলেও তো তাদের কথা বলতে দিতে হবে। কিন্তু, সময় কম এমন অযুহাতে কর্মকর্তাদের কাউকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনারা কেবল তাদের নির্দেশনা দিয়েছে। এ নিয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, আসন্ন নির্বাচনে ইসির আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। প্রশাসনের চাপে ঠিক তফসিলের আগে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে যাচ্ছে ইসি, এমন ইঙ্গিত পেয়েছে কর্মকর্তারা। বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তাদের দাবি, কথা বলতে দিলে রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রসঙ্গ আসবে। তাই কথা বলার সুযোগ রাখেনি ইসি।
তবে, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের কারও কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য থাকলে তা নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়।
বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিগত সময়ের কার্যক্রমে হারানো ইমেজ আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কোন ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে। কেউ কোন অনিয়মের সাথে জড়িত হলে প্রমাণ পেলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি পরবর্তীতে আর কোন দায়িত্বে অনিয়মকারী কর্মকর্তাকে রাখা হবে না।
ব্রি. জে. অব. আবুল ফজল মো সানাউল্লাহ জানান, ডিসি ও ইউএনওরা মাঠ পর্যায়ে নতুন। এসব কর্মকর্তাদের আপনাদের নির্বাচনের কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার যেই নিয়োগ পান না কেন, তাদের সহযোগিতা ও সমন্বয় করে নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের অফিস বা বাসায় যাতায়াত করা যাবে না। বিশেষ দলের অফিস ও বিশেষ জায়গায় ইসির কোনো কোনো কর্মকর্তা যান, সে তথ্য, অভিযোগ ও প্রমাণ তাদের কাছে আছে। এ বিষয়ে সাবধান হওয়ার পরামর্শ জানিয়ে এই কমিশনার আরও বলেন, সেটা করা যাবে না। আজকের পর থেকে কেউ এটা করে থাকলে পুরো দায়ভার ও দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো আনোয়ারুল ইলসাম সরকার বলেন, মাঠ পর্যায়ের আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসাররা দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তাদের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের সুন্দর সুসম্পর্ক ও সমন্বয় আছে, যা আমি বিভিন্ন এলাকার কর্মশালায় গিয়ে দেখেছি। সেজন্য আপনারা যারা মাঠে আছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে আপনাদের রিপোর্ট ও তথ্যের ওপর নির্ভর করেই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নির্দেশনা দেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, নির্বাচন কমিশন শুধু পাঁচজনই নয়। নির্বাচন কমিশন হলো আপনারা মাঠে যারা আছেন সবাইকে বুঝায়। অতএব সেভাবেই আপনাদের সঠিক ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার তাহমিনা আহমদ বলেন, এবারের নির্বাচনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্র রয়েছে। অতএব এবারের নির্বাচন যদি সঠিকভাবে না হয়, তাহলে দেশই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেজন্য আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করে নির্বাচন উঠাতে হবে।

মাসুদ রায়হান পলাশ