তিন দাবিতে ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতিতে রামেকের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা
হলের ছাদ থেকে পড়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের হাতে চিকিৎসক লাঞ্ছিত ও হাসপাতালে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ তিন দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতি শুরু করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। শনিবার দুপুরে হাসপাতালের সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইমরান হোসেন।
এদিকে, রাবি শিক্ষার্থী কে জি এম শাহরিয়ারের মৃত্যু পরবর্তী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে হামলা, মারধর এবং ভাঙচুরের ঘটনায় রাবি ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার নগরীর রাজপাড়া থানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া অভিযোগে হাসপাতালে ভাঙচুর ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরের জন্য রাবি শিক্ষার্থীদের দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে একই থানায় রাবি কর্তৃপক্ষের অভিযোগে শাহরিয়ারের মৃত্যুর জন্য হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলা ও এর প্রতিবাদ করায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মচারীরা আটকে রেখে মারধর করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে পুলিশ দুটি মামলার কোনটিই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রেকর্ড করেনি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মামলা দুটি রেকর্ড করে তারা রাজশাহীর দুটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করাতে চান না। দুটি অভিযোগপত্রই পুলিশ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে রেখে দিয়েছে।
রামেক হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে বৃহস্পতিবার মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও রাজশাহী সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও বিএমএর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. নওশাদ আলী, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ও মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান অংশ নেন। মানববন্ধন থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া মামলা রেকর্ড করে তিন দিনের মধ্যে হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এই ঘোষণার পর দুপুর আড়াইটা থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি শুরু করে। এর আগে রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিজেদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে কর্মবিরতি পালন শেষে শুক্রবার থেকে হাসপাতালে যোগ দিয়েছিল ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আবারও কর্মবিরতি শুরু করায় প্রায় অচল হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ এই হাসপাতালটি। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), বিভিন্ন কেবিনসহ ৫৭টি ওয়ার্ডে দিনরাত রোগীদের ভরসা ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। পুরো হাসপাতালে প্রায় ২৯০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করেন। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা শুধু সকালে একবার ওয়ার্ডে রাউন্ড দেন। বাকি সময় জুনিয়র কিছু নিয়মিত চিকিৎসক ছাড়া মূলত ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাই হাসপাতাল চালান। এখন ইন্টার্নদের কর্মবিরতির কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
এর আগে গত বুধবার রাতে রাবির শহীদ হবিবুর রহমান হলের তৃতীয় ব্লকের ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার। ওই রাতে তাঁকে হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহরিয়ারকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় আইসিইউ চেয়ে না পাওয়া এবং সঠিক সময় চিকিৎসা না হওয়ার অভিযোগ তুলে রাবি শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে ভাঙচুর চালান। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনাও ঘটে। এরপর রাবি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করতে থাকে। পরবর্তীতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে রাত দুটার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যায়।
নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, রাবি শিক্ষার্থীদের হাতে ইন্টার্ন চিকিৎসক লাঞ্ছিত ও হাসপাতালে ভাঙচুরের প্রতিবাদে ওই দিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি শুরু করে। তারা রাবি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাবির অজ্ঞাতনামা ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাজপাড়া থানায় অভিযোগ দেয়। পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কাজে ফেরেন এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে তারা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। আল্টিমেটামের সময়ের মধ্যে মামলা রেকর্ড না হওয়া এবং কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় শনিবার দুপুরে হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে তারা। মানববন্ধন থেকে তারা টানা ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার পর দুপুর আড়াইটা থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি শুরু করে।
ফলে হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক না থাকায় দুর্ভোগ নিয়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী রোমানা খাতুনের বাবা উম্মর আলী বলেন, ‘নার্সরা কয়েকটা ইনজেকশন লিখে দিয়েছে। কোনো ডাক্তার নাই। এখন এই ইনজেকশন লাগবে কি না, তা দেখার মতোও কাউকে পাচ্ছি না। বৃহস্পতিবার সকালে শুধু বড় ডাক্তারেরা একবার রোগী দেখে গেছেন। এখন আর কাউকে পাচ্ছি না।’
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আমগাছি গ্রামের ইদ্রিস আলী হাসপাতালে গত কয়েকদিন থেকে ভর্তি আছেন। তাঁর ভাতিজা মাসুদ রানা বলেন, ‘হাসপাতালে একজন ডাক্তারেরও দেখা পাচ্ছি না। ওয়ার্ডে শুধু নার্সরা আছেন। ওষুধ কিনে এনে তাঁদেরও দুই, চার-পাঁচবার করে ডাকতে হচ্ছে। এখন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ।’
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘ইন্টার্নরা তাঁদের দাবি নিয়ে কর্মবিরতিতে গেছে। সিনিয়র ডাক্তাররা দায়িত্ব পালন করছেন। ইন্টার্নরা না থাকলে রোগীদের সমস্যা তো হবেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ারের মৃত্যুর পর হাসপাতালে যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমরা লিখিত অভিযোগ দিলেও মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। আমরাও ইন্টার্নদের দাবি যৌক্তিক মনে করছি।’
অপরদিকে, রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অন্য শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগে রাবি কর্তৃপক্ষও আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজপাড়া থানায় এই অভিযোগ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএসএম সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রাবি কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি অভিযোগ দিয়েছে। দুটি অভিযোগেরই তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
শুধু পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নয়, শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে শহীদ হবিবুর রহমান হল প্রশাসন। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন উপাচার্যের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে সৃষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি তদন্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১১ সদস্যের আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও আলাদা কমিটি করে ঘটনা তদন্ত করছে।